নয়াগ্রামের উপর পাতিনায় সুবর্ণরেখার বুকে সম্প্রতি দৃশ্যমান হয়েছে পাথরের ‘সেতুবন্ধন’। —নিজস্ব চিত্র।
সুবর্ণরেখার ভাঙনের ফলে প্রকাশ্যে এল মাকড়া পাথরে তৈরি আবহাওয়া অনুকূল সেতুর নিদর্শন! অন্তত গবেষকদের প্রাথমিক ধারণা সেই রকমই।
ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রামের উপর পাতিনা এলাকায় ওই পাথরের সেতুর নিদর্শনটি কমপক্ষে ছ’শো থেকে হাজার বছরের পুরনো বলে মনে করা হচ্ছে। নয়াগ্রাম ব্লকের উপর পাতিনা থেকে নদীর অপর প্রান্তে বেলিয়াবেড়া ব্লকের কালিঞ্জা যাওয়ার জন্যই কি পাথর ফেলে কোনও এক প্রাচীন কালে ওই ফেয়ার ওয়েদার সেতু তৈরি করা হয়েছিল?
উপর পাতিনা গ্রামের বাসিন্দা পবিত্র জানা বলছেন, ‘‘নদীর পাড় ভাঙায় কয়েক বছর আগে দু’-এক জায়গায় মাকড়া পাথর দেখা যেত। এ বার প্রায় ২৫ ফুট চওড়া নদীর পাড় ভাঙায় ডিসেম্বরে পর পর পাথরগুলি দেখা যেতে থাকে। এরপর নদীর জল কমে যাওয়ায় এখন মাকড়া পাথরের সেতুটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’’ মনে হচ্ছে নদীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতেই হয়তো পাথর ফেলে সেতু বানানো হয়েছিল। পরপর সাজানো পাথরগুলি ৫ থেকে ২০ ফুট চওড়া।
স্থানীয়রা জানালেন, ওই এলাকার কিলোমিটার খানেকের মধ্যে জঙ্গলের মাঝে রয়েছে একটি মাকড়া পাথরের গুহা, যেটি আদিম মানবের গুহা বলে এলাকায় জনশ্রুতি। স্থানীয়রা বলেন ‘মাজনা গুহা’। পর্যটকরাও ওই গুহা দেখতে আসেন। সুবর্ণরৈখিক এলাকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসারে গঠিত ‘আমারকার ভাষা আমারকার গর্ব’ গোষ্ঠীর কর্ণধার বিশ্বজিৎ পাল সম্প্রতি এলাকা পরিদর্শনের পর জানাচ্ছেন, উপর পাতিনা ও কালিঞ্জার মধ্যে যোগাযোগের জন্য ওই পাথরের সেতু তৈরি হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘নদীতে জল কমলে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে ফেয়ার ওয়েদার সেতু তৈরি হয়। কিন্তু এমন ভাবে নদীর উপর পাথর ফেলে ‘সেতুবন্ধন’ এলাকায় এর আগে দেখা যায়নি।’’
ঝাড়গ্রাম রানি ইন্দিরাদেবী সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তথা প্রত্ন-গবেষক সুশীলকুমার বর্মন বলছেন, ‘‘প্রাচীন কালে যখন নদীর জল গোড়ালি বা হাঁটু সমান থাকত তখন নৌকার পরিবর্তে দু’প্রান্তে যাতায়াতের জন্য সম্ভবত ওই পাথরের সেতু তৈরি করা হয়েছিল। তবে এটা নিতান্তই অনুমানমাত্র। ওই এলাকা থেকে কিলোমিটার চারেক দূরে দেউলবাড় গ্রামে রয়েছে বহু প্রাচীন রামেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটিও মাকড়া পাথরের তৈরি।’’ সুশীলকুমার জানাচ্ছেন, ওই অঞ্চলে বর্গিরা হানা দিয়েছিল। ফলে বর্গি আমল বা তারও আগে কৃষি সমৃদ্ধ এলাকার দু’প্রান্তে সহজ যোগাযোগের জন্য আবহাওয়া অনুকূল পাথরের সেতুটি তৈরি হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলছেন, ‘‘এ বিষয়ে বিশদে সমীক্ষা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন। বিষয়টি রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাব।’’
রামেশ্বর মন্দির ও অদূরে তপোবন জঙ্গল ঘিরে রামায়ণ নির্ভর একটি কিংবদন্তী ওই অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। তপোবনে রয়েছে বাল্মীকির আশ্রম ও হলুদ জলের প্রবাহ 'সীতানালা' ঝর্না। রামেশ্বর মন্দিরের দ্বাদশ শিবলিঙ্গ সুবর্ণরেখার বালি দিয়ে সীতা গড়েছিলেন বলে জনশ্রুতি। এ বার এলাকায় পাথরের সেতুবন্ধের নির্দশনের সঙ্গে রামেশ্বর মন্দিরের যোগসূত্র খুঁজছেন স্থানীয়রা।