সব ঠিক আছে তো? চলছে দেখে নেওয়া। ঘাটালের বিবেকানন্দ পল্লিতে। নিজস্ব চিত্র
দুর্গাপুজোর দিন দশ-পনেরো আগে কাঁধে ঢাক নিয়ে বেরিয়ে যেতেন তাঁরা। ফিরতেন এক-দেড় মাস পরে। কেউ যেতেন মুম্বই, কেউ বা দিল্লি। অনেকে আসতেন কলকাতায়। কিন্তু এ বার কী হবে! দুর্গাপুজোর যদিও মাসখানেক দেরি, তবে পঞ্জিকা মতে মহালয়া বৃহস্পতিবার। কিন্তু এখনও পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় কোনও ঢাকিই বায়না পাননি।
অন্য বছর এই সময় ঢাকের ‘ফিটিং’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ঢাকিরা। অনেকে ঢাকের খোল তৈরি করেন। নিয়মিত রেওয়াজ হয়। কিন্তু করোনা সব কিছু বদলে দিয়েছে। দাসপুরের রাধাকান্তপুরের প্রবীণ ঢাকি অজিত বিশুই বলছিলেন, “বাইরের কোনও রাজ্য থেকে এখনও ফোন আসেনি। ট্রেনও চালু হয়নি। কলকাতা থেকেও ফোনও আসেনি। সবই অনিশ্চিত। কী হবে, বুঝতে পারছি না।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিন-চার হাজার ঢাকি আছেন। দুর্গাপুজোর সময়ে তাঁদের মধ্যে দেড়-দুই হাজার শিল্পী কলকাতা-সহ দেশের নানা প্রান্তের মণ্ডপে ঢাক বাজাতে যান। অনেকে জেলার মণ্ডপে থাকেন। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অনেকের বাৎসরিক চুক্তি থাকে। কেউ কেউ শুধু পুজোর সময়েই বরাত পান। কেউ আবার প্রবীণ ঢাকিদের সঙ্গী হয়ে বেরিয়ে পড়েন। দুর্গাপুজোর সময়ে যাতায়াত বাদ দিয়ে মণ্ডপে কমবেশি সাত দিনের বরাত থাকে ঢাকিদের। খুব কম হলেও জন পিছু ১৫-২০ হাজার টাকা রোজগার হয়।
কিন্তু এ বার কী হবে?
দেবেন দাস নামে ঘাটালের এক ঢাকি বলেন, “দুর্গাপুজোর মরসুমেই আমাদের প্রায় সারা বছরের রোজগার হয়। কিন্তু এ বার এখনও কোনও ফোন আসেনি।” শীতল রুইদাস নামে চন্দ্রকোনার আরেক ঢাকির কথায়, “আমরা একসঙ্গে আটজন কলকাতায় যাই। কিন্তু এবার তিন জনকে ডেকেছে। বাকিদের এবার যেতে হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে পুজো কমিটি।”
করোনা পরিস্থিতিতে জেলার পুজোতেও কাটছাঁট হয়েছে। সেখানেও কমছে ঢাকির সংখ্যা। দাসপুরের মদন হাজরা, তাপস বিশুইরা বলছিলেন, “ঢাক, কাঁসি নিয়ে এক-একটা দলে পাঁচ-সাত জন করে থাকি। স্থানীয় মণ্ডপগুলি থেকেও আমরা ডাক পেতাম। এবার তাও কম আসছে।” তবে তাঁদের আশা, পুজোর আগে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলে পরিস্থিতি বদলে যাবে।
ঝাড়গ্রামের লালগড়ের উত্তর গোহমি গ্রামের ৫০টি পরিবার মরসুমী ঢাকি। দুর্গাপুজোর মরসুমে ঢাক বাজান তাঁরা। বাকি সময়ে বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করেন নয়তো খেতমজুরি করেন। কিছু পরিবার ভিন জেলায় চাষের কাজে খাটতেও যান। করোনা আবহে এ বার ভিন জেলায় চাষের কাজে যেতে পারেননি তাঁরা। ফলে রোজগারে এমনিতেই টান। তারপরে পুজোয় কী ভাবে তাও নিশ্চিত নয়। মিদ্যাপাড়ার দুলাল মিদ্যা, রাজকুমার মিদ্যা, নগেন মিদ্যারা জানান, অন্য বছর পুজোর সময়ে ঘাটশিলা, মশাবনি, জামশেদপুর থেকে ডাক আসে তাঁদের। এ বছর ট্রেন স্বাভাবিক না হলে যাওয়া সম্ভব নয়।
দুলাল, রাজকুমারেরা জানান, ঘাটশিলা, টাটার মণ্ডপে পাঁচদিন বাজালে জন প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মেলে। খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা উদ্যোক্তারাই করেন। এ বার সেটা অনিশ্চিত। ঝাড়গ্রামের পুজো কমিটিগুলি থেকেও অগ্রিম বায়না করেননি কেউ। তবে এখনই হতাশ হতে রাজি নন তাঁরা। ঘাটালের ঢাকি পাঁচু রুইদাসও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “ঢাকের বোলে মা দুর্গার বোধন হয়। বিসর্জনও হয়। আমরা উপেক্ষিত হলে চলবে কী করে? এখনও তো সময় আছে।” (তথ্য: অভিজিৎ চক্রবর্তী ও কিংশুক গুপ্ত)