এলাকায় রয়েছে সিপিএম, কংগ্রেসের পতাকা। কিন্তু কর্মসূচি থাকলেও দেখা নেই বিজেপির পতাকা বা পোস্টারের। নন্দীগ্রাম বাজারে। নিজস্ব চিত্র
২০০৭ সালে জমি রক্ষার আন্দোলনে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন নন্দীগ্রামের মানুষ। রাজ্যে সেই সময় ক্ষমতাসীন সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজনৈতিকভাবে জয় পেয়েছিল বিরোধী দল তৃণমূল। পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে জয়ের সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই নন্দীগ্রামে তৃণমূলের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রয়েছে এখনও।
একদা প্রধান রাজনৈতিক শত্রু সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তি এখন তলানিতে। কিন্তু বিরোধিতার সেই শূন্যস্থান যে শূন্য থাকেনি তা মানছেন তৃণমূলের একাংশ। সিপিএমকে পিছনে ফেলে প্রধান বিরোধী হিসেবে জেলায় মাথা তুলেছে বিজেপি। ২০১৬ সালের শেষদিকে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে তাঁর প্রথম আভাস মিলেছিল। গত লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। এমনকী নন্দীগ্রাম বিধানসভার মধ্যে থাকা নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের ২৯টি বুথে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে বিজেপি। নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর খাসতালুকে বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত কপালে ভাঁজ ফেলেছে তৃণমূল শিবিরের। যার জেরে লোকসভা ভোটে পিছিয়ে থাকা ওই ২৯ টি বুথে দলীয় নেতৃত্বে রদবদল করা হয়েছে। নন্দীগ্রামের স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে জনসংযোগ বাড়ানোর দিকে জোর দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে রাজ্যের সর্বত্র তৃণমূলের প্রতিবাদের শরিক এই জেলাও।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ও নতুন নাগরিকত্ব আইনের সমর্থনে কাল, ১৮ জানুয়ারি নন্দীগ্রামের টেঙ্গুয়াবাজার থেকে জানকীনাথ মন্দির পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার পদযাত্রা করবেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় দিলীপ নন্দীগ্রাম-২ ব্লকে আমদাবাদ থেকে বিরুলিয়া পর্যন্ত মিছিল করে প্রচার চালালেও নন্দীগ্রাম -১ ব্লকে এই প্রথম পা রাখছেন তিনি। যদিও বিজেপির এই কর্মসূচি নিয়ে নন্দীগ্রামে এখনও প্রকাশ্যে প্রচার নেই। নেই পোস্টার, ব্যানার। যদিও তৃণমূলের স্থানীয় কর্মীদের একাংশের মতে, প্রকাশ্যে প্রচার নেই ঠিকই। তবে গোপনে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। এলাকায় বিজেপির সমর্থকও আছে। বিজেপির এই কর্মসূচি ঘিরে ইতিমধ্যেই নন্দীগ্রামে চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামের টেঙ্গুয়া বাজার, নন্দীগ্রাম বাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জাতীয় নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা সম্পর্কে বিজেপির রাজ্য সভাপতির সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য ঘিরে তাঁরা অনেকেই শঙ্কিত।
জমি রক্ষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া কেন্দেমারি গ্রামের মৌলানা সাজাহান বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারে যে কোনও দল। কিন্তু দিলীপবাবু সভায় যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে শঙ্কা থাকে বই কী। তাই নন্দীগ্রামে বিজেপির কর্মসূচি নিয়ে আমরা চিন্তায় রয়েছি।’’ জমিরক্ষা আন্দোলনে নিহত হয়েছিলেন কালীচরপুর পঞ্চায়েতের ৭ নম্বর জালপাইগ্রামের কোয়েম কাজি। কোয়েমের দাদা দাইয়ান কাজি বলেন, ‘‘২০০৭ সালে জমি রক্ষা আন্দোলনের সময় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলাম। কিন্তু বিজেপি যে ভাবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, নতুন নাগরিকত্ব আইনের নামে বিভেদমূলক প্রচার করছে তাতে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। কাল এখানে বিজেপি রাজ্য সভাপতির রাজনৈতিক কর্মসূচি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা রয়েছে।’’
নন্দীগ্রাম থানার এক পুলিশ আধিকারিক জানান, নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে শুক্রবার থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তিনদিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান রয়েছে। তাঁদের অনুমতিও রয়েছে। এরই মাঝে বিজেপির কর্মসূচির বিষয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। তা সত্ত্বেও কর্মসূচির কথা জেনে ওদের দিন পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল। যদিও নন্দীগ্রাম-১ ব্লক বিজেপি নেতা তথা জেলা সম্পাদক গৌরহরি মাইতি বলেন, ‘‘কাল আমাদের কর্মসূচির বিষয়ে পুলিশকে জানানো হয়েছিল। তবে পুলিশ অনুমতি দেয়নি। তাই ওইদিন সকাল ১১ টা থেকে কর্মসূচি পালন করব বলে পুলিশকে জানিয়েছি।’’
নন্দীগ্রাম-১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি মেঘনাদ পাল বলেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ যতবারই নন্দীগ্রামে আসুক না কেন, কোনও লাভ হবে না। নন্দীগ্রামের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেই আছেন এবং থাকবেন।’’