পাঁশকুড়ার মাইশোরা এলাকায় স্কুলের অদূরে পড়ে রয়েছে মদের বোতল। নিজস্ব চিত্র Diganta Manna
কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় তোলপাড় গোটা রাজ্য। প্রশ্ন উঠছে মহিলাদের নিরাপত্তা, প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। আগামী দিনে এ রকম ঘটনা আটকাতে পুলিশের শীর্ষস্তর থেকে থানা, ট্র্যাফিক গার্ড-সহ সমস্ত পুলিশ কর্মীর উদ্দেশ্যে ১৫ দফা নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে রবিবার।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বড় কোনও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এ রকম নির্দেশিকা প্রত্যেকবার জারি হয়। তার পর কিছু দিন কাটতে না কাটতেই সব আবার যে কে সেই। এই ধরনের নির্দেশিকা কি আগে কখনও জারি হয়নি? নারী সুরক্ষার জন্য পুলিশের সাধারণ যে নির্দেশিকা রয়েছে, তা কি আদৌ সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে? নতুন নির্দেশিকা কার্যকর করতে গেলে জেলায় যে পরিকাঠামো এবং বাহিনী দরকার, তা আদৌ আছে? আরজিকর কাণ্ডের অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় মদ্যপ ছিল বলে জানা গিয়েছে। মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গেলে পুলিশি নজরদারির পাশাপাশি রাজ্যে মদ ও সমস্ত ধরনের মাদক দ্রব্য নিষিদ্ধ করার দাবিতেও সরব হয়েছে একাধিক সংগঠন।
কয়েক দিন আগেই মেচেদা স্টেশনে ফুট ব্রিজের উপর এক তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার ঘটনা ঘটে। বাধা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন তরুণীর মা। আক্রান্ত তরুণী চিৎকার করেও কোনও পুলিশি সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ। গত বছর পাঁশকুড়ার ঘোষপুর এলাকায় এক মহিলাকে তাঁর বাড়ির মধ্যে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কোলাঘাটের বড়দাবাড়ে দিনের বেলায় এক প্রৌঢ়াকে বাড়ির মধ্যে খুন করে সর্বস্ব লুট করার অভিযোগ ওঠে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়টি অনেকটাই বেআব্রু। দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের জন্য পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করছেন বেশির ভাগ মানুষ।
অভিযোগ, সন্ধ্যা নামলেই জেলার বিভিন্ন রাস্তা সমাজবিরোধীদের দখলে চলে যায়। বসে মদের আসর। অনেক রাস্তায় পথবাতি ইচ্ছাকৃত ভাবে ভেঙে দেয় দুষ্কৃতীরা। মূল রাস্তাগুলিতে পুলিশের টহলদারি থাকলেও অন্যত্র পুলিশ থাকে না বলে অভিযোগ। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় দুষ্কৃতীরা। পুলিশের শীর্ষস্তর থেকে ১৫ দফার একটি নির্দেশিকা জারি করা হলেও সেটা কি এই অবস্থাকে বদলাতে পারবে?
যদিও পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বলেন,"জেলায় মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরত্ব দিয়ে দেখা হয়। কোথাও কোনও অভিযোগ পেলে দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ করা হয়। নারী সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে স্কুলে-স্কুলে ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছে। নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে। জেলার প্রতিটি থানা এলাকায় উইনার্স বাহিনীর টহল শুরু করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।"নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য 'ইভটিজিং ড্রাইভ' নামে পুলিশের একটি কর্মসূচি রয়েছে। দিঘা, মন্দারমণির মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে এই কর্মসূচি চালায় পুলিশের 'উইনার্স' বাহিনী। হলদিয়াতেও এই কর্মসূচি মাঝে মধ্যে চলে। তবে জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানান, নিয়মিত 'ইভটিজিং ড্রাইভ' চালাতে গেলে যে পরিমাণ পুলিশ ফোর্স এবং গাড়ির দরকার তা থানাগুলির কাছে নেই। ফলে সমস্ত হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, পার্ক ইত্যাদি জায়গায় পুলিশি টহল থাকে না। আরজিকর কাণ্ডের পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পুলিশি নজরদারি প্রসঙ্গে জেলার এক পুলিশ আধিকারিক বলেন,"আমাদের জেলায় মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরত্ব দিয়ে দেখা হয়। কোথাও কোনও অভিযোগ পেলে দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ করা হয়। নারী সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে স্কুলে স্কুলে আমরা স্বয়ংসিদ্ধা নামে একটি কর্মসূচি করছি। নতুন নির্দেশিকা এখনও পাইনি। পেলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।"
মহিলাদের সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার পেছনে জেলায় মাদকের বাড়বাড়ন্তকে দাবি করছেন অনেকেই। জানা গিয়েছে, জেলায় এই মুহূর্তে সরকারি লাইসেন্স প্রাপ্ত মদের দোকান রয়েছে ২৭২ টি। নতুন করে বিভিন্ন জায়গায় আবার লাইসেন্স দিচ্ছে আবগারি দফতর। কার্যত পাড়ায় পাড়ায় মদের দোকান গড়ে ওঠায় এলাকায় মদ্যপ যুবকদের দাপট বাড়ছে। প্রকাশ্য রাস্তায় চলছে মদ্যপান। তারা মহিলাদের উত্যক্ত করছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় হেরোইন এবং গাঁজার মতো মাদকের কারবারও ছড়িয়েছে। পুলিশি অভিযানে মাঝেমধ্যেই গাঁজা উদ্ধার হচ্ছে। রাশ টানা যাচ্ছে না কারবারে। মাদকের কারণে সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি মহিলাদের সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে অভিযোগ। নারী নিগ্রহ বিরোধী নাগরিক কমিটির নেত্রী শ্রাবন্তী মণ্ডল বলেন,"মহিলাদের সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে মাদকের কারণে। অধিকাংশ ঘটনায় অভিযুক্ত নেশাগ্রস্তরা। স্কুল, কলেজের যাওয়ার পথে ছাত্রীরা আক্রান্ত হচ্ছে। সন্ধ্যাবেলায় কিছু বাইকআরোহী মহিলাদের শ্লীলতাহানি করছে। লোকলজ্জার ভয়ে বহু ঘটনাই থানা পর্যন্ত পৌঁছোয় না।"