খেলনা বিক্রির আশায় এক কারিগর। —নিজস্ব চিত্র।
একটা সময় ছিল, যখন গড়বেতায় ঐতিহ্যের বগড়ির দোলমেলায় দেদার বিক্রি হত কাঠের তৈরি খেলনা গাড়ি, পুতুল। কয়েকশো বছরের পুরনো এই দোলমেলায় ছেলেমেয়েদের জন্য সেই খেলনা কিনতে বহু দূর থেকে মানুষ আসতেন। কিন্তু সময় বদলেছে! সেই ঐতিহ্যের খেলনার বিক্রি অনেকটাই কমেছে বলে জানাচ্ছেন মেলায় আসা কারিগরেরা।
কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে তাঁদের যুক্তি, এখন রিমোট-চালিত খেলনায় বাজার ছেয়ে গিয়েছে। ফলে সে সবের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে শিশু থেকে কিশোর সকলের। আর অভিভাবকেরাও তাদের কিনে দিচ্ছেন সেই সব আধুনিক খেলনা। ফলে বিক্রি কমছে কাঠের পুতুল, গাড়ির মতো খেলনার। হুগলি জেলার বদনগঞ্জ থেকে এ বার বগড়ির দোলমেলায় কাঠের গাড়ি বিক্রি করতে এসেছিলেন কারিগর অসিত দাস ও তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা বললেন, ‘‘প্লাস্টিকের, রিমোটের অনেক খেলনা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। সে সবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন এখনকার ছেলেমেয়েরা। তাই কাঠের গাড়ির খেলনা বিক্রি একেবারেই কমে গিয়েছে। এতে আমাদের পেশায় টান ধরছে।’’ বগড়ির দোলমেলায় কাঠের পুতুল, গাড়ি নিয়ে বংশ পরম্পরায় বসতেন পাশের মায়তা এলাকার কয়েকটি পরিবার। এ বার সেই সংখ্যাটাও কম। ওই পরিবারের কয়েকজন সদস্য বললেন, ‘‘আমরা কাঠ জোগাড় করে, মেহনত করে পুতুল, গাড়ি তৈরি করে বিক্রির আশায় দোলমেলায় নিয়ে আসতাম। মোবাইলের যুগে এখন সেই খেলনা বিক্রিই কমে গিয়েছে।’’
অথচ এক সময় কাঠের তৈরি খেলনা পুতুল, গাড়ির একটা ঐতিহ্য ছিল! আমড়া, শিমূল, ছাতিম, শ্যাওড়া প্রভৃতি নরম গাছের ডাল কেটে মাপ মতো কাঠ বার করে, সেখানে কারিগরেরা হাতের নিপুণ শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলতেন মেয়ে পুতুল, ছেলে পুতুল, ছোট ছোট এক চাকা, দু’-তিন চাকার গাড়ি। সেগুলিকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে বিক্রি করা হত। বগড়ির দোলমেলা তো বটেই, অনেক মেলাতেই দেদার বিক্রি হত সেই সব খেলনা। শিশু-কিশোরদের কাছে লোভনীয় সে সব খেলনা বিক্রি করে ভাল আয় করতেন কারিগরেরা। তারাপদ সাঁতরার ‘বাংলার দারু ভাস্কর্য’ বইতে উল্লেখ রয়েছে কাঠের এই সব খেলনার কথা। আবার ‘বাংলার পুতুল’ বইতেও উল্লেখ রয়েছে মায়তার কাঠের পুতুল, ঘোড়া, পালকি প্রভৃতি খেলনার কথা।
এই প্রসঙ্গে লোকসংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করা শিক্ষাবিদ তরুণ সিংহমহাপাত্র বলেন, ‘‘কাঠের পুতুল, গাড়ি, ঘোড়ার মতো ছোটদের খেলনা এখন মেলাতে খুব একটা দেখা যায় না। বগড়ির দোলমেলায় এই সব খেলনা নিয়ে মায়তার কারিগরেরাও খুব একটা আসেন না। অথচ কাঠের এই শিল্পকর্ম খুব পুরনো, এর একটা ঐতিহ্য রয়েছে।’’ ঐতিহ্যের টানেই এ বার বগড়ির দোলমেলায় এসে একটি কাঠের গাড়ি কিনে বাড়ি নিয়ে যান রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-প্রাপ্ত শিক্ষক গড়বেতার সন্ধিপুরের মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি বগড়ির দোলমেলায় কাঠের খেলনা গাড়ি, পুতুল বিক্রি হয়। পুতুল পাইনি, তবে একটা কাঠের গাড়ি কিনে নিয়ে এসেছি বাড়িতে সাজিয়ে রাখব বলে। ঐতিহ্যের এই শিল্প তো হারিয়ে যাচ্ছে।’’