বিষ-মদে খেয়েই অন্ধ হয়ে গিয়েছেন মোহন বেরা। ২০০৯ সালে শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের ওই বিষমদ কাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ৫০জন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই এলাকারই চোলাই ঠেক ভাঙতে গিয়ে আক্রান্ত হতে হল পুলিশকে। অভিযোগ, এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছে দৃষ্টিশক্ত হারানো মোহন বেরার ভাইপো অমিত ওরফে লাল্টু। পুলিশের দাবি, এই লাল্টুই এখন ওই এলাকায় চোলাই মদের ব়ড় কারবারি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রামতারক বাজার সংলগ্ন হোগলবেড়িয়া গ্রামে সোয়াদিঘি খালের উত্তরে একাধিক ঝুপড়িতে চোলাইয়ের রমরমা ব্যবসা চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগও আসে। বেআইনি মদের ব্যবসায়ীদের ধরতে তমলুক থানার এএসআই শঙ্কর মণ্ডল, বিমলেন্দু দাস ও দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ার ওই সন্ধ্যায় সাদা পোশাকে হানা দেন। প্রথমে লাল্টুর মদের ঠেকে হানা দেন তাঁরা। পুলিশ দেখেই সে ঝাঁপ দেয় পাশে সোয়াদিঘি খালের জলে। ধাওয়া করে পুলিশও। অবশেষে জল থেকে তুলে আনা হয় লাল্টুকে।
কিন্তু সে সময় আশপাশের অন্য কয়েকজন মদ ব্যবসায়ী ও তাঁদের দলবল পুলিশ কর্মীদের ঘিরে ফেলে। অভিযোগ তারা হুমকি দেয় লাল্টুকে ছেড়ে দিতে হবে বলে। লাল্টুরই একটি অস্থায়ী ঘরে আটকে রাখা হয় দুই পুলিশ কর্মী ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের। সে সময় ধাক্কাধাক্কিতে এএসআই শঙ্কর মণ্ডল ও পুলিশ কর্মী বিমলেন্দু দাস জখম হন বলেও অভিযোগ। উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। জড়ো হয়ে যান আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। খবর পেয়ে তমলুক থানার ওসি কৃষ্ণেন্দু প্রধান পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার করেন পুলিশ কর্মীদের। পরে পুলিশকে নিগ্রহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় লাল্টু বেরা ও দীপক দোলাই নামে দুই মদ ব্যবসায়ীকে। গ্রেফতার করা হয়েছে চন্দন বেরা, বুলু বেরা, প্রশান্ত মথুর ও মেহেবুব আলি দীন নামে স্থানীয় চারজন বাসিন্দাকেও। জানা গিয়েছে এরা সকলেই ওই দোকানের খদ্দের।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশকে আক্রমণ, সরকারি কাজে বাধা দান ও বেআইনিভাবে মদ ব্যবসার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ দিন রাতে ওই ঘটনার পর পুলিশ ওই এলাকায় থাকা তিনটি মদের ঠেক উচ্ছেদ করে। বেশ কিছু পরিমাণ চোলাই মদ বাজেয়াপ্ত করে। জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
যদিও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য লাল্টুর চোলাই কারবারে যুক্ত হওয়ায় আশ্চর্য় হচ্ছেন না স্থানীয়রা। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, ২০০৯ সালে এখানেই বিষাক্ত চোলাই মদ খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল এলাকায় বহু বাসিন্দার। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ ছিল চোলাইয়ের রমরমা। গত চার বছরে সেই ব্যবসা ফের ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সে সময় যাঁরা ব্যবসা করত, অনেকেই এখন আর ব্যবসা করেন না। বরং নতুন নতুন ছেলেরা শুরু করেছে ব্যবসা। লাল্টুও তাদেরই একজন। গত তিন বছরে এই ব্যবসায় বেশ ‘উন্নতি’ হয়েছে তার। এমনকী বাড়িতে রেফ্রিজারেটর রেখে চোলাই সংরক্ষণ করে সে। কাকা মোহন বেরার অন্ধত্বও তাকে দমাতে পারেনি।
কেন?
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এক টাকার জিনিস দশ টাকায় বিক্রি করতে পারলে আপনিও করতেন। ছাড়বে কেন ওরা?’’
তবে কি সচেতনতা বলে কিছুই থাকবে না? এলাকায় চোলাইয়ের রমরমার কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা তথা বল্লুক-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান ছন্দা মান্না। তিনি বলেন, ‘‘স্থানীয় অনেক বাসিন্দাই মদ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অনেকবার বোঝানো হয়েছে। লাভ হয়নি। পুলিশি অভিযানে দিন কয়েক বন্ধ থাকে ব্যবসা। তারপর যেই কে সেই।’’ পুলিশের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপের দাবি করেন ছন্দাদেবী।
২০০৯-এর ঘটনার পরও থেমে থাকেনি মৃত্যু মিছিল। গত বছর ময়নার আড়ংকিয়রানা বাজার এলাকায় বিভিন্ন চোলাই ঠেকে মদ খেয়ে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কয়েকমাস আগেও খেজুরিতে চোলাই মদ খেয়ে কয়েকজন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হুঁশ ফেরেনি।
তবে সম্প্রতি চোলাই মদ বিক্রি বন্ধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন মহিলারাই। শঙ্করপুর মৎস্য বন্দর লাগোয়া এলাকায় চোলাই ঠেক ভেঙে দেয় প্রমীলা বাহিনী। ভেঙে দেওয়া হয়েছে একটি সরকারি ক্যান্টিন-সহ ১৬টি চোলাই মদের দোকান। নষ্ট করে দেওযা হয়েছে কয়েক হাজার টাকার চোলাই মদ। রামনগর-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নিতাই সারের অভিযোগ, ‘‘শুধু ঝুপড়ি বা স্থানীয় দোকান নয়, চোলা বিক্রি চলত স্থানীয় একটি সরকারি ক্যান্টিনেও।’’ তিনি আরও জানান, শুক্রবার মৃত্যুঞ্জয় বাগ নামে এক মৎস্যজীবী চোলাই খেয়ে মাছ ধরার বোটেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে দিঘা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। এরপরেই স্থানীয় ও মৎস্যজীবী পরিবারের মহিলারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে চোলাই ঠেকগুলিতে অভিযান চালান।
বেআইনিভাবে মদ বিক্রির অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে হলদিয়ার চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গভীর রাতে মদের ভাটিও ভাঙে পুলিশ। ধৃতরা হলেন নিমাই জানা, লক্ষণ দাস, ভিখারি ওঝা ও ননীগোপাল গাইন। তদের হলদিয়া আদালতে তোলা হলে বিচারক ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন।