মায়ের কোলে। করোনা- জয়ী খুদে। মেদিনীপুর মেডিক্যালে। নিজস্ব চিত্র।
বিষয়টা ছিল এই শিশুদের জীবন-মরণের। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ওঠা-নামার মধ্যে লড়াইটা ছিল হার না মানার। কারও বয়স ৫ মাস, কারও ৭ মাস। কেউ জ্বরে ভুগছিল, কেউ শ্বাসকষ্টে। খুদে শরীরেই হানা দিয়েছিল করোনাভাইরাস। চিকিৎসা হয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে। করোনাকে হেলায় হারিয়ে, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে একরত্তিরা।
কেউ হাসপাতালে ভর্তির ৭-৮ দিনের মাথায় বাড়ি ফিরেছে, কেউ ১০-১২ দিনের মাথায়। মাঝের সময়টায় অবশ্য যমে-মানুষে টানা লড়াই চলেছে। উদ্বেগ-উৎকন্ঠার প্রহর গোনা চলেছে। শেষমেশ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের মুখে ফের ফিরেছে হাসি। করোনা-জয়ী এক শিশুর মা বলছিলেন, ‘‘চারদিকে যন্ত্রণা, মৃত্যু, হাহাকার দেখছি। যখন শুনলাম ছেলের করোনা হয়েছে, ভীষণ দুশ্চিন্তা হত। চিকিৎসকেরা অভয় দিয়েছিলেন। ছেলে সুস্থ হয়ে উঠেছে। চিকিৎসক-নার্সদের ধন্যবাদ।’’
মেদিনীপুর মেডিক্যালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তারাপদ ঘোষ জানালেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন করোনা সংক্রমিত শিশু এখান থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। তিনি মানছেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। বাড়তি নজর রাখা হয়েছিল। সবার চেষ্টাতেই এই সাফল্য।’’ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লে আরও বেশি সংক্রমিত হতে পারে শিশুরা। এই পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমিত বেশ কয়েকজন খুদেকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরাতে পেরে খুশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। মেদিনীপুর মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পঞ্চানন কুণ্ডুও বলেন, ‘‘করোনা সংক্রমিত বেশ কয়েকটি শিশুকে সুস্থ করে পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারা গিয়েছে। আমাদেরও খুব ভাল লাগছে।’’
করোনার প্রথম ঢেউ সে ভাবে ছোঁয়নি শিশুরা। মেডিক্যালের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তারাপদও মানছেন, ‘‘তুলনায় করোনা সংক্রমিত শিশুর সংখ্যা এ বারই বেশি।’’ জানা যাচ্ছে, গত প্রায় দেড় মাসে করোনা সংক্রমিত ২১ জন মেডিক্যালের শিশু বিভাগে ভর্তি হয়েছে। কেউই পজ়িটিভ হয়ে এখানে আসেনি। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি প্রভৃতি উপসর্গ নিয়ে এসেছে। ভর্তির পরে করোনা রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছে। জানা যাচ্ছে, ওই ২১ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে ১৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ৭ জন সুস্থ হওয়ার পথে। বছর দুয়েকের এক শিশুরই মৃত্যু হয়েছে। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘বাচ্চাটির অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। হাসপাতালে আসার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মারা যায়।’’
হাসপাতাল সূত্রে খবর, দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখনও পর্যন্ত যে ২১ জন করোনা সংক্রমিত শিশু বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তার মধ্যে ৫ ৭ মাস বয়সী ৯ জন, ১-৫ বছর বয়সী ৫ জন, ৬-১২ বছর বয়সী ৭ জন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এদের বেশিরভাগই কোনও করোনা সংক্রমিতের সংস্পর্শে ছিল না। অর্থাৎ, বাবা- মা, বাড়ির পরিজনেরা করোনা সংক্রমিত ছিলেন না।
কিন্তু কী ভাবে শিশুরা করোনার সঙ্গে যুঝতে পারছে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মার টিকা, এমএমআর টিকা বেশিরভাগেরই নেওয়া থাকে। এগুলি খানিকটা হলেও সুরক্ষা দিচ্ছে শিশুদের। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। সাধারণত শিশুদের কো-মর্বিডিটি কম। রক্তচাপ বা ডায়াবিটিসের সমস্যাও নেই। যে সব সমস্যা বয়স্কদের থাকে। তাই শিশুরা সংক্রমিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে রোগের ভয়াবহতা তুলনামূলকভাবে কম। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘বংশগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও একটা কারণ। যার ফলে করোনায় শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার বা হলেও জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা কম থাকে।’’ আইএমএ-র মেদিনীপুর শাখার সম্পাদক কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত বলেন, ‘‘খুদেরাও জয় করছে করোনাকে। এ তো স্বস্তিরই, আশারও।’’