প্রতীকী চিত্র। নভেল করোনাভাইরাস।
করোনা যোগে এ বার জুড়ে গেল পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা। রাজ্যের দশম করোনা-আক্রান্ত, কলকাতার বাসিন্দা বৃদ্ধ এগরায় এক বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। করোনা সংক্রমিত হয়ে এখন তিনি কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুরসভা ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এগরা পুর-এলাকার এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ছেলের বিয়ে ছিল গত ১৩ মার্চ। সেই অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের অতিথিরা আমন্ত্রিত ছিলেন। ওড়িশার বালাসোর, ভুবনেশ্বর, রৌরকেল্লা, হায়দরাবাদ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের বোকারো, মধ্যপ্রদেশের আমন্ত্রিতরা ছাড়াও আমেরিকা ও সিঙ্গাপুর থেকে ওই চিকিৎসকের চার বন্ধুও এসেছিলেন। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান সেরে দিঘাতেও গিয়েছিলেন ওই বৃদ্ধ। ফলে, তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, এমন লোকজনকে চিহ্নিত করা শুরু করেছে প্রশাসন।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিতাইচন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘‘এগরায় বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া কলকাতার বাসিন্দা ওই ব্যক্তির কাছাকাছি এসেছিলেন এমন ১৩জনকে চিহ্নিত করে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তাঁদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠানো হবে। তাঁর সংস্পর্ষে আরও যাঁরা এসেছেন, তেমন লোকজনের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’’ রাজ্যের মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীরও বক্তব্য, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক, জেলাশাসক-সহ সবাই মিলে সমগ্র পরিস্থিতি দেখাশোনা করছেন। দ্রুত সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করে হোম আইসলোশনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। আতঙ্কের কিছু নেই।’’
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, করোনা-আক্রান্ত কলকাতার বছর ছেষট্টির ওই বৃদ্ধ এগরার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ভায়রাভাই। বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্ত্রী, ছেলে, বৌমা, নাতনি এবং হাওড়ার এক পরিচিতকে নিয়ে গত ১২ মার্চ গাড়িতে এগরায় পৌঁছন বৃদ্ধ এবং একটি হোটেলে আসে। ওই বৃদ্ধের ছেলে হরিয়ানায় থাকেন। ১৩ মার্চ সপরিবার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এগরা ১ ব্লকে পাত্রীর বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। ১৪ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ এগরার হোটেলেই সপরিবার ছিলেন ওই প্রৌঢ়। ১৫ মার্চ বৌভাতের প্রীতিভোজে যান তাঁরা।
ওই প্রীতিভোজে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি, স্কুলের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্টজনই হাজির ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে ১৬ মার্চ বিদেশি অতিথিরা ফিরে যান বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। ওই দিনই কলকাতার বাসিন্দা বৃদ্ধ স্ত্রীকে দিঘা বেড়াতে যান। সেখানেও হোটেলে ওঠেন। ১৭ মার্চ তাঁর জ্বর আসে। ১৮ মার্চ শুরু হয় প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। দিঘার হোটেল মালিক তখন, গাড়ি ঠিক করে ওই দম্পতিকে এগরায় পাঠিয়ে দেন। সেখানেই একটি নার্সিংহোমে রক্তপরীক্ষা করিয়ে এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করান ওই বৃদ্ধ। ১৮ থেকে ২২ মার্চ তিনি অসুস্থ অবস্থায় এগরায় আত্মীয় চিকিৎসকের বাড়িতেই ছিলেন।
গত ২২ মার্চ তাঁর শ্বাসকষ্ট বাড়ে। কিন্তু ওই দিন জনতা কার্ফু ছিল তাই তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২৩ মার্চ খুব ভোরে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বুধবার তাঁর লালারস করোনা-পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেই রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।
এই ঘটনা জানাজানি হতেই জেলা স্বাস্থ্য দফতর ও এগরা পুর-প্রশাসনের তৎপরতা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার এগরা পুরসভায় জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের উপস্থিতিতে জরুরি বৈঠক হয়। এগরা ও দিঘার যে দু’টি হোটেলে ওই বৃদ্ধ উঠেছিলেন সেগুলি সিল করেছে স্বাস্থ্য দফতর। বৃদ্ধের সংস্পর্শে আসা এগরার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের গোটা পরিবার, হোটেলের পরিচারিক, দুই হাতুড়ে চিকিৎসক এবং প্রীতিভোজের অনুষ্ঠানে হাজির কেটারিং কর্মীদের ‘হোম আইসোলেশন’-এ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর কারা ওই করোনা-আক্রান্ত বৃদ্ধের সংস্পর্শে এসেছেন, তার খোঁজ চালাচ্ছেন পুরসভা এবং স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনা-সঙ্কটের মধ্যে কেন ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল? ওই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, এ দেশে তখনও এই পরিস্থিতি হয়নি। তা ছাড়া, ওই বৃদ্ধের শ্বাসকষ্ট ছিলই। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ওঁর আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট ছিল। তবে উনি সুস্থ অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিদেশ থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ওঁর আলাপও হয়নি। যেহেতু আমাদের দেশে করোনা নিয়ে তখন জরুরি অবস্থা ছিল না, তাই বাড়তি গুরুত্বও দেওয়া হয়নি।’’