‘‘প্রচারে তো মুখ দেখাতে পারছি না। আর কতজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এড়িয়ে যাব?’’
বলছেন এগরার স্থানীয় তৃণমূল নেতারা অনেকেই। সারদা, নারদ কেলেঙ্কারির পর শাকের উপর আঁটির বোঝা চাপিয়েছেন তাঁদের প্রার্থী সমরেশ দাস। শুক্রবারই সমবায় ব্যাঙ্কের আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এগরার তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আর তাতেই স্থানীয় নেতারা প়ড়েছেন ফ্যাঁসাদে। স্থানীয় এক নেতার আক্ষেপ, ‘‘প্রচারে এ সব দুর্নীতির প্রসঙ্গ যত এড়িয়ে যাচ্ছি ততই আমাদের ব্যক্তিগত ‘ইমেজ’ কালিমালিপ্ত হচ্ছে। আমরা কী জবাব দেব ভোটারের কাছে।”
সমবায় দুর্নীতিতে তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে আগেই সবর হয়েছিলেন বিরোধীরা। শুধু তাই নয়, গত জানুয়ারিতে এগরা কেন্দ্রের তৃণমূল নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশ সমরেশ দাসকে ফের প্রার্থী না করার দরবার করেছিলেন দলনেত্রী ও জেলা সভাপতির কাছে। সেখানেও সমবায়ের এই দুর্নীতির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাম ঘোষণা হয়েছে সমরেশেরই। শুক্রবারই তৃণমূলের এক বিক্ষুব্ধ নেতা বলেছিলেন, “সমরেশ রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ব্যাঙ্ক থেকে। দলের সকলেই তা জানে। তিনি ও তাঁর ছেলে যে কোনও দিন জেলে যাবেন তাও জানা সকলেরই।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এখনও সময় আছে প্রার্থী বদল করার। নইলে এগরা আসনটি হাতছাড়া হবেই।”
ভোটের মুখে হাইকোর্টের এমন নির্দেশে ফের উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে বাম-কংগ্রেস জোট। গত মাসেই বিক্ষুব্ধ হিসাবে দলত্যাগ করেছিলেন তৃণমূলের প্রাক্তন শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ মামুদ হোসেন। তিনিই এ বার এগরা কেন্দ্রে বিরোধী জোট প্রার্থী। মামুদ বলেন, “তৃণমূল নেতারা যে কতটা সততার প্রতীক তা মানুষের কাছে স্পষ্ট। সমরেশবাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নানা তদন্তে প্রমাণিত জেনেও তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে।’’ তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘‘গোটা বিষয়টিতে তৃণমূলের অধিকারীদের প্রশ্রয় রয়েছে।”
সমরেশবাবু জেলা রাজনীতিতে অধিকারী শিবিরের লোক বলেই পরিচিত। অন্যদিকে, অধিকারী-বিরোধী শিবিরের বলে পরিচিত পটাশপুরের বিদায়ী বিধায়ক জ্যোতির্ময় কর রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী। জ্যোতির্ময়বাবু দায় এড়িয়ে বলেছেন, “বিষয়টি আমার জানা ছিল না। মন্ত্রী হিসাবে আমার কাছে দফতর থেকে কোনও সুপারিশ আসেনি। আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরে আমি কোনও মন্তব্য করব না।”
২০০৯ সালে শিশিরবাবুর হাত ধরে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েই এই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট পান সমরেশ দাস। ২০০৯ ও ২০১১— দু’বারই বিধায়ক হন। তার আগে ২০০১ সালে অবশ্য সিপিএমের প্রার্থী হিসাবে সমরেশবাবু পরাজিত হন রামনগর কেন্দ্রে। সিপিএম সূত্রে খবর, ওই সমবায় ব্যাঙ্কে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠতেই দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। তবে বাম শরিক পশ্চিমবঙ্গ সমাজবাদী পার্টিতে যুক্ত থেকে তৎকালীন মৎস্য মন্ত্রী কিরণময় নন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন সমরেশবাবু। ২০০৬ সালে তাঁকে আর টিকিট দেয়নি সিপিএম। এরপরই দলবদল।
স্থানীয়রা বলছেন, ব্যাঙ্কে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে সমরেশবাবু বরাবরই ক্ষমতাশালীদের ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে বিধায়ক হওয়ার দৌড়েও থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে। ফলও মিলেছিল। ব্যাঙ্কে তাঁর অনৈতিক কাজে বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি কোনও দল। বলাগেড়িয়া সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের এক উচ্চপদস্থ কর্মী বলেন, “২০১১ সালে তিনি শাসক দলের বিধায়ক হওয়ার পর থেকেই দুর্নীতি লাগামছাড়া হতে থাকে। ব্যাঙ্কের লোকসানকেও তিনি গ্রাহ্য করেননি।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন, “তৃণমূলে সমরেশ দাস ব্যতিক্রম নয়। ক্ষমতার জোরে এ সব চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকার আদালতের নির্দেশ কার্যকর না করলেও আমরা ক্ষমতায় এসে ব্যবস্থা নেব।” দলের রাজ্য কমিটির সদস্য সুকুমার রায় থেকে শুরু করে কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক মানস করমহাপাত্ররা জানান, সমরেশ দাসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের রিপোর্ট অনেকের হাতেই এসে গিয়েছে। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধরাই এসব ছড়িয়েছেন। ওই নথি দেখে মানুষ তৃণমূল প্রার্থীর স্বরূপ চিনছেন। জোটও এই বিষয়টি নিয়ে জোরদার প্রচার শুরু করছে। তাঁদের দাবি, জোটপ্রার্থীর জয় নিয়ে তাঁরা একরকম নিশ্চিত ছিলেন। আদালতের ওই নির্দেশের পর জয়ের ব্যবধান অনেকটাই বাড়বে বলে আশা করছেন তাঁরা। শুক্রবার সমরেশ দাস দাবি করেন দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাঙ্কের কর্মী ও আধিকারিকদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুধু সমরেশবাবু নন, তাঁর ছেলে পার্থসারথী দাসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ। পার্থবাবু এগরা-২ পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ।