প্রতীকী ছবি।
কাটমানি কি এ বঙ্গের ‘মানি হেইস্ট’!
হাতের কাজ মিটিয়ে এক চিলতে অবসরে আড্ডার সময় ‘মানি হেইস্ট’-এর সঙ্গে কাটমানির তুলনা টেনেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি থানার এক পুলিশকর্মী। মুর্শিদাবাদে এক ওসির মুখে কাটমানি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। তা নিয়েই চলছিল আলোচনা। কেউ বাম আমলের সঙ্গে এখনকার পুলিশের কাজের তুলনা করছিলেন, কেউ প্রকাশ করছিলেন অসহায়তা। তারই ফাঁকে জনপ্রিয় ওয়েবসিরিজ়ের প্রসঙ্গ তুলে টিপন্নী কেটেছিলেন ওই পুলিশকর্মী। মুখের কথা মাটিতে পড়তে না দিয়েই লুফে নিলেন আরেক পুলিশকর্মী। বললেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের ওসি মুখ ফস্কে আসল কথাটা বলে ফেলেছেন। কথাটা তো ভুল কিছু বলেননি।’’
পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম, দুই জেলার পুলিশকর্মীদের একটা অংশের মতে, এখন কাজের ধরন ও প্রকৃতি অনেক বদলে গিয়েছে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে হচ্ছে সব কিছুই। আইনশৃঙ্খলারক্ষার সঙ্গে হয়তো সরাসরি তার যোগ নেই। তবু নির্দেশ মেনে পালন করতে হচ্ছে বহু সামাজিক দায়িত্ব। আবার এর উল্টোদিকও রয়েছে। সাদা চোখে কোনও ঘটনা আইনশৃঙ্খলা সমস্যা হিসেবে সামনে এলেও পুলিশ পৌঁছে বুঝতে পারছে এ নেপথ্য রয়েছে ‘অন্য কিছু’ (পড়ুন কাটমানি)। মুর্শিদাবাদের ওসি এ সমস্যার কথাই বলেছেন। দিনকয়েক আগেই চন্দ্রকোনা-১ ব্লকে একটি রাস্তা তৈরিকে কেন্দ্র করে পথ অবরোধ হয়। ঘটনার গভীরে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, পছন্দের ঠিকাদারের কাজ পাওয়া নিয়ে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর মাথাদের জন্যই ওই গোলমাল। সেখানে পৌঁছে সেই ‘কাটমানির’ অভিযোগ কানে আসে পুলিশের। সমাধানে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ‘কাটমানি’কে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা’র অবনতির কথা স্বীকার করলেও পুলিশের অসহায়তার দাবি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, এ সব ক্ষেত্রে পুলিশও পরিস্থিতির ফায়দা নিতে ছাড়ে না। শাসক দলের সঙ্গে যোগসাজশে কাটমানির ভাগ পৌঁছয় তাদেরও কাছে। যদিও এ সব অবান্তর বলে উড়িয়ে দিয়েছে শাসকদল। আর পুলিশের মুখে কুলুপ।
ঘাটালের এক প্রবীণ পুলিশকর্মী তাঁর অভিজ্ঞতা কথা বলছিলেন। বদলে যাওয়া পরিবেশ, পরিস্থিতির কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘একসময় আইনশৃঙ্খলা ছাড়া জরুরি প্রয়োজন না হলে পুলিশকে ‘নাক’ গলাতে হত না। বাম আমলে তো অনেক ছোটখাটো দুর্ঘটনা পুলিশ পৌঁছনোর আগেই মিটমাট হয়ে যেত।’’ আরেক প্রবীণ পুলিশ কর্মী মানছেন, “এমন একটা সময় ছিল, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও আইনশৃঙ্খলার বাইরে অন্য বিষয়গুলি নিয়ে পুলিশকে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হতো না। এখন তো দেখছি, নিরাপত্তা জনিত কারণ ছাড়াও যে কোনও ঘটনার গভীরে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে পুলিশকে।” সম্প্রতি ঘাটালের এক প্রাথমিক স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না কে করবে, তা নিয়ে গোলমাল হয়। রান্নাঘরেও তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, শাসক দলের এক গোষ্ঠীর মদতেই স্কুলে এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন মহিলারা। গোয়ালতোড়ের হুমগড়ে স্থায়ী সেতুর দাবিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তিনদিন ধরে চলা পথ অবরোধ তুলতে পুলিশকে কম মেহনত করতে হয়নি। চড়া রোদে বসে থাকা ছাত্রছাত্রীরা যাতে কেউ অসুস্থ না হয় সেদিকে যেমন দেখতে হয়েছে পুলিশকে, তেমনি তাদের প্ররোচনা দিয়ে কেউ উত্তেজনা সৃষ্টি না করে, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে উর্দিধারীদের। জেলার এক পুলিশকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সেতু করার দায়িত্ব সেচ দফতরের, তা দেখভাল করবে পঞ্চায়েত ও জেলা প্রশাসন। আর আমাদের তিনদিন ধরে সামলাতে হচ্ছে অবরোধকারী ছাত্রছাত্রীদের।’’
পুলিশককর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, থানায় কালীপুজো বাম আমলেও হতো। কিন্তু এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন, রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন-সহ নানা সামাজিক কাজ। এ সব কাজ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলার কাজটা ফাঁকি পড়ে যাচ্ছে না, প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। আর পুলিশকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, পুলিশ সামাজিক দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু সে জন্য তো অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। মাস কয়েক আগের কথা। পুলিশকে এক সামাজিক কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে। নির্দেশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। ‘উপর’ থেকে বরাদ্দ শূন্য। ‘ম্যানেজ’ করতে হবে ‘নীচ’ থেকেই। কী ভাবে কী হবে, ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না মেদিনীপুরের একটি থানার পুলিশকর্তা। তিনি শুনিয়েছিলেন, ‘‘খরচ তো কম নয়। কী যে করি! প্যান্ডেল, চেয়ার, টেবিলের ব্যবস্থা করতেই হাজার ছয়েক লাগবে। মাইক, সাউন্ড সিস্টেমে হাজার দুয়েক। এরপর মঞ্চের ব্যাকড্রপের ফ্লেক্সও করাতে হবে।’’ তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘কেউ কেউ আমাদের তোলাবাজ বলেন। এ সব তো দেখেন না!’’
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য, পুলিশ কখনও স্থানীয় ব্যবসায়ী কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঘাড়ে এ সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। ঝাড়গ্রামেও পুলিশের উদ্যোগে বিভিন্ন গ্রামে জনসংযোগ কর্মসূচি চলছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা শিবির ‘মিশন সুস্বাস্থ্য’। তার জন্য কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও এসএসকেএম-এর চিকিৎসকদের সাহায্য নিয়ে ওই কর্মসূচি হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারা নিজেদের ব্যক্তিগত পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের কর্মসূচি চালান।
‘কাটমানি’ কি আগে ছিল না? পশ্চিম মেদিনীপুরের এক বাম নেতা বললেন, ‘‘ছিল তো বটেই। কিন্তু কাটমানির কি এমন মারকাটারি বাজার ছিল? উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কাটমানির শতাংশ নিয়ে অঙ্ক কষতে বসলে এখন কে সি নাগও লজ্জা পেতেন।’’
(তথ্য সহায়তায়: কিংশুক গুপ্ত, বরুণ দে, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, রঞ্জন পাল)