সংবর্ধনা সভায় ছত্রধর মাহাতো। শনিবার লোধাশুলির পথসাথী ভবনে। নিজস্ব চিত্র।
নতুন স্লোগান তৈরি করছেন জনসাধারণের কমিটির প্রাক্তন নেতা ছত্রধর মাহাতো। নিজের গ্রামের উন্নয়নের অধিকার বুঝে নিতে গ্রামে গ্রামে ‘আপনা গাঁও, আপনা রাজ’ কমিটি চালু করতে চান তৃণমূলের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক। সূত্রের খবর, এনআইএ মামলা মুক্ত হয়ে ঝাড়গ্রামে ফেরার পর পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে দফায় দফায় ঘরোয়া বৈঠক করেছেন ছত্রধর।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের পর্যবেক্ষণ, এতদিন জঙ্গলমহলে জনসাধারণ কমিটির যে সব লোকজন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিলেন, ছত্রধর ফেরায় তাঁদের একাংশ অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এমনকি ছত্রধরের পুরনো সঙ্গী বর্তমানে কেউ তৃণমূলের নেতা, কেউ জেলা পরিষদের সদস্য, কেউ স্পেশাল হোমগার্ড তাঁরাও ছত্রধরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এমনিতেই উন্নয়নের ভাগাভাগি নিয়ে ঝাড়গ্রাম জেলায় তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠী রয়েছে। তার মধ্যে ছত্রধরের সক্রিয়তা ভাবাচ্ছে শাসকদলকে।
ইউএপি মামলায় জেলমুক্ত হওয়ার পর ছত্রধরকে তৃণমূলে পুনর্বাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদকের পদও পান ছাত্রধর। সেই পার্থ এখন জেলে। ফলে ছত্রধরের পক্ষে নিজের গুরুত্ব আদায়ে পুরনো পথই অপেক্ষাকৃত সহজতর। সেই কারণেই পুরনো সঙ্গীদের সভায় ছত্রধরকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘কী ভাবে অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হয়, আমরা বিগত দিনে করে দেখিয়েছি। আমাদের সে পথ তো খোলা আছে। এক যুগেরও বেশি জেল খেটেছি। দরকার হলে আবার জেলে যাব!’’
নিজের গুরুত্ব বোঝাতে ছত্রধর জঙ্গলমহলে গ্রামোন্নয়নের বিষয়টিকেই বেছে নিতে চান বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন। এখনও এলাকার যোগ্য বহু মানুষ সরকারি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়াও তোলাবাজি-ঠিকাদারি, বালি মাফিয়ারাজের ঘটনাগুলিতেও নিচু তলায় ক্ষোভ ছড়াচ্ছে। ফলে মানুষের মন পেতে ছত্রধর কিন্তু জনজাতি-কুড়মি ভারসাম্যের তাস খেলতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গলমহলে জনজাতিদের মধ্যে সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা সহ অনেক সম্প্রদায় রয়েছে। কুড়মিরাও কোনও কোনও এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই স্লোগান তৈরির ক্ষেত্রে কোনও একটি জনজাতি কিংবা মূলবাসীদের বিশেষ ভাষাকে না বেছে ছত্রধর পরাধীন ভারতে চুয়াড় বিদ্রোহের স্লোগানের খণ্ডিত অংশ ব্যবহার করতে চাইছেন। চুয়াড় বিদ্রোহের শহিদ রঘুনাথ মাহাতোর স্লোগান ছিল: ‘আপনা গাঁও, আপনা রাজ, দূর ভাগাও বিদেশী রাজ’। এ প্রসঙ্গে ছত্রধর বলছেন, ‘‘জন্মস্থান আমাদের মায়ের সমতুল্য, মায়ের সন্তানদের অবমাননা ও বঞ্চনা দেখে চুপ করে থাকা যায় না।’’ ছত্রধরের ব্যাখ্যা, ‘‘এই ধরনের ‘আপনা গাঁও, আপনা রাজ’ মানে নৈরাজ্য সৃষ্টি নয়, বরং প্রতিটি গ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের অধিকার থাকুক। এটাই চাইছি।’’
বছর দেড়েক আগে এনআইএ মামলায় জামিন পেলেও কলকাতা হাই কোর্টের বিধিনিষেধে এতদিন ঘরে ফিরতে পারেননি ছত্রধর। সম্প্রতি কলকাতার বিশেষ আদালত ছত্রধরকে এনআইএ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। ঝাড়গ্রামে ফেরার পর পুরনো সঙ্গীরা ছত্রধরকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। তবে জেলা তৃণমূলের তরফে ছত্রধরকে কোনও সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। কিন্তু ছত্রধরের মতো ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করার মতো উপায়ও যে নেই সেটা মানছেন শাসকদলের একাংশ। সেই কারণে কয়েকদিন আগে জেলা কমিটির বৈঠকে ছত্রধরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ছত্রধর ওই বৈঠক এড়ান। শনিবার লোধাশুলিতে তাঁর পুরনো সঙ্গী ও অনুগামীদের আয়োজিত এক সভায় ছত্রধর সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্নও ছুড়ে দিয়েছেন। যাঁরা বাম আমলে তৃণমূলকে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার জন্য সাহায্য করেছিল, ছত্রধরের সেই সব পুরনো সঙ্গীসাথী জেলমুক্ত হলেও একাধিক মামলায় তাঁরা জর্জরিত। এখনও অনেকে পুনর্বাসন প্যাকেজের আওতায় না আসায় স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি পাননি। শনিবারের সভায় ছত্রধর জানিয়েছিলেন, ১৪ বছরের শাসনকালে যদি এখনও কিছু মানুষ বঞ্চিত থাকেন, তাঁদের জন্য কাজ করার জায়গা না পেলে নিজেই জায়গা খুঁজে নেবেন। তবে ছত্রধরের ক্ষেত্রে সাবধানী তৃণমূল নেতৃত্ব। ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মু বলছেন, ‘‘উনি (ছত্রধর) যা বলছেন, সেগুলি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। এ নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ বিজেপির জেলা সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডুর কটাক্ষ, ‘‘২০১১ সালে যাদের সাহায্য নিয়ে তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে।’’
বিধানসভা ভোটের আগে নিজের এলাকায় ফিরেছেন ছত্রধর। ভোটের আগেই সাংগঠনিক স্তরে রদবদলের ভাবনাচিন্তা রয়েছে শাসক দলে। যদিও এই মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা আপাতত গতি হারিয়েছে। এই আবহেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে ছত্রধরের বার্তা এবং ‘আপনা গাঁও, আপনা রাজ’ কমিটি চালুর ভাবনা ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছে পর্যবেক্ষকদের একাংশ।