রেল বাজেটে চোখ। বৃহস্পতিবার খড়্গপুর স্টেশনে। নিজস্ব চিত্র।
এ বার রেল বাজেটে বাংলার প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে দু’টি ‘ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর’। দু’টির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে রেলশহর খড়্গপুর। বৃহস্পতিবার লোকসভায় রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু খড়্গপুর-মুম্বই ও খড়্গপুর-বিজয়ওয়াড়া প্রস্তাবিত ফ্রেট করিডরের ঘোষণা করায় তাই খুশির হাওয়া স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলে। কারণ, এর ফলে কম সময়ে পণ্য পরিবহণের সুযোগ মিলবে। কমে যাবে পরিবহণ খরচ। সেই সঙ্গে মালগাড়ির আনাগোনা বাড়লে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে।
এখন খড়্গপুর ডিভিশনে রেলের সাধারণ লাইনেই মালগাড়ি চলাচল করে। একই লাইনে মালগাড়ি ও যাত্রিবাহী ট্রেন যাতায়াত করায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মালগাড়িকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়। কিন্তু ‘ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর’ হলে শুধু মালগাড়ি চলাচলের জন্য পৃথক লাইন থাকবে। ফলে, পণ্য পরিবহণে গতি আসবে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রাজা রায় বলেন, “খড়্গপুরে থেকে দু’টি ফ্রেট করিডর রেলের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর জেরে দুই মেদিনীপুরের ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে। শিল্প সংস্থা থেকে ছোট ব্যবসায়ী, সকলেই নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য আদান-প্রদান করতে পারবেন।”
এর ফলে, পরোক্ষে পরিবহণ-শিল্পও উপকৃত হবে বলে ব্যবসায়ীদের মত। কারণ, মালগাড়ির যাতায়াত বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই আরও বেশি ট্রাক-লরির প্রয়োজন পড়বে। আর মালগাড়িগুলি নির্দিষ্ট সময়ে যাতায়াত করলে এখনকার মতো লোকসান হবে না। খড়্গপুর ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক উজ্জ্বল দাসের কথায়, “প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ হয়। এখন মালগাড়ি দেরিতে আসে বলে আমাদের পরদিন পর্যন্ত ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এতে লোকসান বাড়ে। ফ্রেট করিডর দিয়ে ঠিক সময়ে মালগাড়ি এলে এই সমস্যা থাকবে না।” সেই সঙ্গে পণ্য ওঠানো-নামানোর পরিমাণ বাড়লে কাজের সুযোগ বাড়বে বলেও আশা করা হচ্ছে।
খড়্গপুর রেল ডিভিশনে পণ্য পরিবহণের উপরে হলদিয়া ও খড়্গপুর শিল্পতালুক অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিভিন্ন শিল্পসংস্থা তাদের কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য মালগাড়িতেই আনা-নেওয়া করে। সেই পণ্য পরিবহণ থেকে আয় করে রেলও। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, খড়্গপুর ডিভিশনে মূলত, কয়লা, আকরিক লোহা ও সার পরিবহণ হয়। গত কয়েক বছরে এর থেকে আয় ক্রমশ বাড়ছে। যেমন, ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে পণ্য পরিবহণে প্রায় ৮৪৫ কোটি টাকা আয় করেছিল খড়্গপুর ডিভিশন। ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে তা বেড়ে হয় প্রায় ১০৭৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে এ বছর জানুয়ারি পর্যন্ত আয়ের পরিমাণ প্রায় ১০৬৭ কোটি টাকা।
খড়্গপুর রেল ডিভিশনের কমার্শিয়াল বিভাগের এক আধিকারিকের কথায়, “পণ্য পরিবহণে প্রতিবছর আমাদের ডিভিশনে আয় বাড়ছে। তারপরেও অনেকসময় আমরা রেক দিতে পারি না। সেই নিরিখেই ফ্রেট করিডর চালুর চিন্তা বলে মনে হচ্ছে।” খড়্গপুর রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল কমার্শিয়াল ম্যানেজার কুলদীপ ত্রিপাঠীরও মত, “আমরা তো বিগত পাঁচ বছরে যা আয় হয়েছে ও আগামী পাঁচ বছরে কত আয় হতে পারে সেই রিপোর্টও পাঠাই। তার ভিত্তিতেই হয়তো রেল বোর্ড মনে করেছে ফ্রেট করিডর করা যেতে পারে।”
অবশ্য এই ফ্রেট করিডরের জন্য কত টাকা খরচ হবে তা জানা যায়নি। এমনকী খড়্গপুরে কোন এলাকায় এই করিডরে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ চলবে তাও স্পষ্ট নয়। ফ্রেট করিডরের রুট নিয়ে কিছু বলতে পারেননি খড়্গপুরের ডিআরএম রাজকুমার মঙ্গলা। তবে রেলের কমার্শিয়াল বিভাগের আধিকারিকদের ধারণা, ফ্রেট করিডরের জন্য খড়্গপুর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় আলাদা করে জমি বের করা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে খড়্গপুর-মুম্বই ফ্রেট করিডরের জন্য নিমপুরা সাইডিং এবং খড়্গপুর-বিজয়ওয়াড়ার জন্য হিজলির কাছে কোথাও পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ হতে পারে। ওই বিভাগের এক রেল আধিকারিকের কথায়, “সবে ফ্রেট করিডরের কথা ঘোষণা হয়েছে। আমাদের কাছে কাগজপত্র এলে সমীক্ষা হবে। তারপর বরাদ্দ মতো গোটা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হবে।”
এই ফ্রেট করিডর ঠিক কোন কোন এলাকা সংযুক্ত করবে, তার উপরই নির্ভর করছে বিভিন্ন শিল্প সংস্থার লাভের হিসেব। যেমন হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের ইলেক্ট্রো কাস্টিংস লিমিটেডের ম্যানেজার (পার্সোনেল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনশিপ) অভিষেক দাশগুপ্ত বলেন, “আমাদের সংস্থার কাঁচামাল আকরিক লোহা, কয়লা ওড়িশার বরবিল থেকে মালগাড়িতে আসে। তাই ওই দু’টি ফ্রেট করিডরে বরবিল সংযুক্ত না থাকলে আমাদের লাভ হবে না।” একই ভাবে খড়্গপুরের নিমপুরা শিল্পতালুকের রশ্মি মেটালিক্স-২ কারখানার ম্যানেজার (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ভাস্কর চৌধুরীর বক্তব্য, “ওড়িশার পারাদ্বীপ থেকে আমাদের কয়লা আসে সড়কপথে। ফ্রেট করিডর পারাদ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে। তাই লাভের অঙ্ক দেখতে পাচ্ছি না।’’