তখন তাঁরা ঝাড়গ্রামে। এক স্থানীয়ের থেকে পরবর্তীর গন্তব্যের পথনির্দেশ জেনে নিচ্ছেন জয়ন্ত। পিছনে স্ত্রী রেশমি। নিজস্ব চিত্র ।
হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই, অথচ ‘চার চাকার স্কুটি’ চালিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন এক ভ্রমণপিপাসু বাঙালি। সম্প্রতি ঝাড়গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন হুগলির কোন্নগরের বাসিন্দা জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়। সফরে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী রেশমি। বছর পঞ্চাশের জয়ন্তের দু’টি পা পক্ষাঘাতে অচল। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। রেশমির সাহায্য ছাড়া স্কুটি থেকে ওঠা-নামাও করতে পারেন না। অথচ পেশায় রেলকর্মী জয়ন্ত কোন্নগর থেকে ১৮০ কিলোমিটার স্কুটি চালিয়ে ঝাড়গ্রামে হাজির হয়েছিলেন।
জয়ন্তের কথায়, ‘‘ইউটিউব ও সমাজমাধ্যমে ঝাড়গ্রামের দর্শনীয় জায়গাগুলি দেখে মন টানল। তাই চলে এসেছি।’’ গত শুক্রবার সকাল সাতটায় কোন্নগর থেকে রওনা দিয়ে দুপুর দু’টোয় ঝাড়গ্রাম শহরে পৌঁছন জয়ন্ত ও রেশমি। ওঠেন শহরের অরণ্যসুন্দরী অতিথিশালায়। অতিথিশালাটির মালিক শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় হলেন ‘ঝাড়গ্রাম হোটেল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’এর যুগ্ম সম্পাদক। শিবাশিস বলেন, ‘‘মনের জোরের কাছে শারীরিক সমস্যা যে কোনও বাধা নয়, সেটা জয়ন্তবাবু আরও একবার প্রমাণ করলেন।’’ প্রসঙ্গত, জয়ন্তের স্কুটির ট্যাঙ্কে মাত্র পাঁচ লিটার পেট্রল ধরে। সেই কারণে মালপত্রের সঙ্গে স্কুটিতে পেট্রলের জ্যারিকেনও নিয়ে ঘুরেছেন পুরো যাত্রাপথ।
হুগলির কোন্নগরের বিশ্বম্ভর ব্যানার্জি লেনের বাসিন্দা জয়ন্ত উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে হাঁপানিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে দু’টি পা-ই অসাড় হয়ে যায়। প্রায় ১৬ বছর শয্যাশায়ীও ছিলেন তিনি। তারপর সুস্থ হলেও, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পাননি। দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসাও করিয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে শরীরের নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাত হয়েছে।
এরপর ভাগ্যের চাকা ঘোরে ২০১৩ সালে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের কোটায় রেলে চাকরি পান। এখন বালিতে সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার (ওয়ার্কস) অফিসে কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত। প্রতিদিন কোন্নগর থেকে আট কিলোমিটার স্কুটি চালিয়ে কর্মস্থলে যান। সঙ্গে থাকেন রেশমিও। আগে তিন চাকার হুইল চেয়ারে যেতেন, বছর পাঁচেক আগে চার চাকার স্কুটি কেনেন। চাকরি পাওয়ার পরে ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন। হুগলির জনাইয়ের রেশমি সব জেনে শুনেই জয়ন্তের দায়িত্ব নিয়েছেন। দম্পতি জানালেন, এর আগে সাহস করে ২০১৯ সালে প্রথমবার স্কুটিতে দিঘা বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা।
জয়ন্ত বলেন, ‘‘ইচ্ছে রয়েছে আগামী বছর স্কুটি চালিয়ে দার্জিলিংও যাব।’’ ফোনে কোন্নগর থেকে জয়ন্তর বাবা দুলালচন্দ্র ও মা মিনা বলেন, ‘‘মনের জোর আর ইচ্ছেটাই তো আসল।’’ রেশমি জানালেন, জয়ন্ত ভাল ছবি আঁকেন, গান করেন, সিন্থেসাইজ়ার বাজান। নিজের পোশাকও নিজে সেলাই করতে পারেন। স্ত্রীকে চূড়িদারও বানিয়ে দেন। জয়ন্ত বলছেন, ‘‘বাড়ি ফিরে গিয়ে ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ির ছবি আঁকব।’’ যাঁর অসাড় পায়ের তলাতেও সর্ষে, তাঁকে রোখে সাধ্য কার!