লড়াকু: গানের মঞ্চে বোধায়ন। নিজস্ব চিত্র
মাসে কখনও এক বার, কখনও বা দু’-তিন বার রক্ত নিতে হয় তাঁকে। সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছ’ঘণ্টা ধরে চলে ইঞ্জেকশন। একঘেয়ে ওই শুয়ে থাকার সময়টাই বদলে দিয়েছে বারুইপুরের থ্যালাসেমিয়া রোগী, বছর আঠারোর বোধায়ন অর্ণবকে। ছেলের একঘেয়েমি কাটাতে ওই সময়ে মা চালিয়ে দিতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত বা আধুনিক গান। যা শুনে শুনে এখন গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বোধায়ন। সঙ্গে চলে আবৃত্তিও। গত বছর রাজ্য যুব উৎসবে সঙ্গীতে প্রথম হন তিনি।
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও ছিল। বারুইপুর হাইস্কুল থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করা বোধায়ন বললেন, “ছোট থেকে ভুগছি। তবে হার মানতে চাই না। আমার মতো ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াতে ডাক্তার হব ভেবেছিলাম। এখন সঙ্গীত নিয়ে পড়ার ইচ্ছেটাই বেশি।”
ছেলের স্বপ্ন কতটা সফল করতে পারবেন, জানেন না বোধায়নের বাবা-মা। বাবা অলককুমার অর্ণব বললেন, “বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গ্রামীণ শাখাগুলির ভল্ট ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখাই আমাদের কাজ। ট্রেন বন্ধ থাকায় এখন বাড়িতেই বসা। স্ত্রী মিতালি আইসিডিএস-এর কর্মী। ছেলের চিকিৎসা ও পড়ার খরচ কতটা জোগাতে পারব জানি না।”
১৯৯৭ সালে বিয়ে হয় অলককুমার ও মিতালিদেবীর। ২০০১ সালে ছেলের জন্মের ছ’মাসের মাথায় জানতে পারেন, দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। তাই বোধায়ন থ্যালাসেমিয়া রোগী। অলককুমার জানান, প্রথম দিকে দু’-তিন মাস অন্তর রক্ত দিতে হত বোধায়নকে। বয়সের সঙ্গে রক্তের চাহিদাও বাড়তে থাকে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়। গত বছর পরিস্থিতি এমন হয় যে, বোধায়নের ‘স্প্লিনেকটমি’ করাতে হয়। অস্ত্রোপচারে প্লীহা বাদ যাওয়ার পরে এখন প্রতি মাসে তাঁর এক ইউনিট করে রক্ত লাগে।
এর মধ্যেও পড়াশোনা, আবৃত্তি বা সঙ্গীতচর্চা বন্ধ হয়নি বোধায়নের। ১৪ বছর বয়সের মধ্যেই আকাশবাণীতে একাধিক অনুষ্ঠান করা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। দূরদর্শনে তাঁকে নিয়ে হয়েছে অনুষ্ঠান। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের রাজ্য শিশু উৎসবে টানা ন’বার অংশ নিয়ে বোধায়ন প্রতি বারই পুরস্কার জিতেছেন। শনিবার তিনি বললেন, “দাদুর কাছেই প্রথম আবৃত্তি শিক্ষা। রবীন্দ্রসঙ্গীত মায়ের কাছে। এই মুহূর্তে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্থায় আবৃত্তি, পূবালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর পাপিয়া চক্রবর্তীর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছি। রবীন্দ্রভারতীতে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই।” কৃতী ছাত্রের প্রশংসা তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের গলাতেও। বোধায়ন তবু বলেন, “লকডাউনের জন্য তো অর্থনীতির পরীক্ষাটাই হল না। ওটা হলে ফল আরও একটু ভাল হত।”
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের থ্যালাসেমিয়া কন্ট্রোল ইউনিটের অন্যতম সচেতক মৌমিতা বিশ্বাস বললেন, “অসুখ কখনও কাউকে হারাতে পারে না। অসুখ থাকবে, কিন্তু তা নিয়েও একটা আপাত সুস্থ জীবনযাপন যে করা সম্ভব, তা-ই করে দেখাচ্ছেন বোধায়ন। আশপাশের লোকজনকে সচেতন করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদেরও ভাল ভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।” তবে তাঁর পরামর্শ, “বিয়ের আগেই থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করান। তখন না করালে সন্তান গর্ভে আসার ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যেও প্রি-নেটাল পরীক্ষার পথ খোলা থাকে।”
বিয়ের সময়ে তাঁরা যে ততটা সচেতন ছিলেন না, বোধায়নের বাবা-মা তা মেনে নিয়েছেন। অলকবাবুর কথায়, “রাজ্য যুব উৎসবে ছেলে মান্না দে-র ‘অভিমানে চলে যেও না’ গানটা গেয়ে প্রথম হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি যেন কাউকেই শেষের ওই গান গাইতে না হয়। নিজের ছেলের জীবন দিয়ে এ কথা বুঝছি।”