মনোরঞ্জনা সিংহ ও মাতঙ্গ সিংহ
নামেই জেল হেফাজত। আসলে হাসপাতালের বিলাসবহুল সুইট!
এক জন ধরা পড়ার পরে একটা গোটা দিনও জেলে থাকেননি। অন্য জনের কারাবাস সামান্য কয়েক দিনের। প্রথম জন মনোরঞ্জনা সিংহ, দ্বিতীয় জন রমেশ গাঁধী। সিবিআই দু’জনকেই সারদা-কাণ্ডে গ্রেফতার করেছে। সোমবারও মাতঙ্গর জামিন খারিজ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। দিন কয়েক আগে মনোরঞ্জনার জামিনের আর্জিও খারিজ হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে। সিবিআইয়ের চোখে ‘প্রভাবশালী’ ওই দুই বন্দি আদালতের নির্দেশে যে ভাবে হাসপাতালে বিলাসে দিন কাটাচ্ছেন, এই মামলায় যুক্ত আইনজীবীদের অনেকেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সারদা মামলার অন্যতম আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘চিকিৎসার নামে বিলাসবহুল জীবনযাপনের পাশাপাশি এঁরা মামলা ও তদন্তে প্রভাব খাটানোর সুযোগও পেয়ে যেতে পারেন। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল গঠন করে ধৃতদের প্রকৃত শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য উচ্চ আদালতে যাওয়ার বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি।’’
আইনজীবীদের অভিযোগ সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে। সারদা মামলায় ষুক্ত এক আইনজীবীর মন্তব্য, সিবিআই ওই দুই জনকে ‘প্রভাবশালী’ বলে দেখিয়ে প্রতি বারই জামিনের বিরোধিতা করছে, কিন্তু তাঁরা যে হাসপাতালে বিপুল বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন— সে প্রসঙ্গটি আদালতে তুলছে না। অসুস্থ বলে জেল এড়িয়ে মনোরঞ্জনা যে-ভাবে দিনের পর দিন হাসপাতালের বিশেষ সুইটে আত্মীয় পরিজন নিয়ে থাকছেন, সে বিষয়টি কেন সিবিআই আদালতকে জানাচ্ছে না, তা নিয়েও সরব আইনজীবীদের একাংশ।
এক আইনজীবীর মন্তব্য, প্রাক্তন পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্র এসএসকেএম হাসপাতালে থাকাকালীন আদালতে নানা প্রশ্ন তুলেছিল সিবিআই। তাঁরা বলেছিল, মদনবাবু সরকারি প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু মনোরঞ্জনা ও রমেশ গাঁধীর ক্ষেত্রে সিবিআই চুপ। মদন মিত্রের আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ঠেস দিয়ে বলেন, ‘‘ওদের হয়তো এমন কোনও অসুখ হয়েছে, যার চিকিৎসা সরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে হয় না! তাই বেসরকারি হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। ওদের কী অসুখ হয়েছে, তা এ বার যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে।’’
মনোরঞ্জনার আইনজীবী বিপ্লব গোস্বামী অবশ্য এ সব অভিযোগকে আমল দিতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা চিকিৎসকের রিপোর্ট পেশ করে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির আবেদন করেছিলাম। আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর আমার মক্কেলের ভরসা কম।’’
সিবিআই সূত্র জানাচ্ছে, বছর খানেক আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের স্ত্রী মনোরঞ্জনা সিংহকে। কিন্তু গ্রেফতারের পর তিনি এখনও পর্যন্ত জেলের মুখ দেখেননি। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকে একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসাপাতালে প্রেসিডেন্সি সুইটে ভর্তি হন। মাস ছয়েক আগে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা হাসপাতালে মনোরঞ্জনার বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছিলেন। তার পরই ওই হাসপাতালের তরফে মনোরঞ্জনাকে অন্যত্র চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করা হয়। এখন তিনি ইএম বাইপাস সংলগ্ন একটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। শুধু বেড ভাড়া বাবদই দিনে ১৫ হাজার টাকা দিচ্ছেন মনোরঞ্জনা
সিবিআই সূত্রের খবর, আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সারদাকাণ্ডে ধৃত রমেশ গাঁধী। রমেশবাবুর ক্ষেত্রে ওই হাসপাতাল নতুন নয়। সারদা কাণ্ডের আগেও কয়েক বার অন্য কয়েকটি মামলায় রমেশবাবুকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তখনও তিনি ওই হাসপাতালের প্রেসিডেন্সি কেবিনেই থাকতেন। এ ক্ষেত্রে রমেশবাবু ওই হাসপাতালেই রয়েছেন। সারদা-কাণ্ডের আরও এক ধৃত সদানন্দ গগৈ-ও ভর্তি রয়েছেন সোনারপুরের কামালগাজি এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
কিন্তু হাসপাতালের জীবনযাপন প্রসঙ্গ আদালতে তুলছে না কেন সিবিআই? সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘ধৃতেরা অসুস্থতার কাগজ দেখিয়ে আদালতের অনুমতি নিয়েই বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছেন। আমরা নজর রেখেছি। সারদার টাকাতেই যে ওঁরা হাসপাতালের বিল মেটাচ্ছেন এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। কীসের ভিত্তিতে আদালতে যাব?’’ ওই কর্তার কথায়, ‘‘কে কোন হাসপাতালে কী ভাবে থাকবেন, তা নির্ভর করছে আদালতের নির্দেশের উপর। ধৃতদের কেবিনে আত্মীয় পরিজনদের যাওয়া-আসা ও থাকার বিষয়টিও আদালতের নির্দেশেই হয়। তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে আমরা ধৃতদের শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট ওই হাসপাতালের কাছ থেকে নিয়ে আদালতে পেশ করি মাত্র।’’
তবে হাসপাতালের রিপোর্টে কী ভূত রয়েছে, তা দেখতে আদালতে যেতে চান আইনজীবীদের একাংশ।