মহানগরের রোজনামচায় চাপা পড়ে গেল তাৎপর্যপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ঘটনা! সম্প্রতি কলকাতার ভারত সভা হলে ১২ বছর পরে প্রকাশ্যে দেখা গেল মাওবাদী দুই শীর্ষ নেতাকে। উপলক্ষ, সিপিআই (মাওবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত হিমাদ্রি সেন রায় ওরফে সোমেনের স্মরণসভা। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই (মাওবাদী)-র পলিটব্যুরোর সদস্য নারায়ণ সান্যাল, রাজ্য কমিটির সদস্য চণ্ডী সরকার এবং রাজ্য কমিটির মুখপাত্র গৌর চক্রবর্তী। সিপিআই (মাওবাদী) গঠিত হওয়ার সময়ে ২০০৪ সালে কলকাতার শহিদ মিনারে প্রকাশ্য সভায় হাজির ছিলেন মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্ব। এর পরে সকলেই আত্মগোপন করেন।
প্রায় এক যুগ পরে নারায়ণবাবু, চণ্ডীবাবুর মতো নেতাদের প্রকাশ্যে আসাটা কোনও কাকতালীয় বিষয় নয়। কারণ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা কয়েক মাস আগেই ঘোষণা করেছে মাওবাদীরা। তার পরেই বাম মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে নেপালের মতোই কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে ভারতের মাওবাদীরাও? এই প্রথম বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি। মাওবাদীদের সর্বশেষ যে বুলেটিন প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে ইঙ্গিত রয়েছে, গ্রামে এই সব কর্মসূচি নিজেদের মতো করে পালন করলেও শহরে তা ‘আইন’ মেনেই করতে চায় তারা। মাওবাদীদের এই পরিবর্তিত অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের মূল স্রোতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি।
দু’দশক ধরে মূলত দেশের বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে লাগাতার সশস্ত্র সংগাম করলেও যত দিন যাচ্ছে, ততই ওই সব অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে পুলিশ ও আধা-সেনার অভিযান। এই পরিস্থিতিতে দলের ভিতরে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থেকে গণ-আন্দোলনের কথা বলছিল, তাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে কেন্দ্রীয় কমিটি এক রকম বাধ্য হয়েছে বলেই মাও-বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, চলতি বছর নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর। আর নকশালবাড়ি আন্দোলনে যে বিপ্লবের সব চেয়ে বেশি প্রভাব ছিল, মাও জে দঙের নেতৃত্বে চিনের সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও ৫০ বছর পূর্তি। এই দু’টি বিষয় এবং কার্ল মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি। এত দিন এই ধরনের কর্মসূচি সাধারণত মূল স্রোতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকেই পালন করতে দেখা যেত। সমাজের বিস্তৃত অংশের মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়ে গ্রামাঞ্চলে যেখানে সংগঠন আছে, সেখানে নিজেরাই এ সব কর্মসূচি পালন করবে মাওবাদীরা। শহরাঞ্চলে মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল গণ-সংগঠন এবং ছোট ছোট মঞ্চ যাতে এই কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা যোগাযোগ ঘটাতে পারে, তার জন্যই ‘আইন মেনে’ তা পালন করার কথা বলেছেন সংগঠনের নেতৃত্ব।
মাসছয়েক আগে দলের সাধারণ সম্পাদক গণপতি দেশের সমস্ত ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন, পথ এবং কৌশল নিয়ে বিভিন্ন বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। এত দিন সমমতাবলম্বী বিদ্বজ্জন ছাড়া কারও কথা মাওবাদীরা শুনত তো না। বরং, ভিন্ন মতের বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা দিতেও কসুর করত না।
মাওবাদীদের এই সিদ্ধান্তে খুশি দেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নকশালপন্থী সংগঠন সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন। দলের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘মাওবাদীদের আমরা দেশের শত্রু মনে করি না। মত পার্থক্য আছে। কিন্তু চাই, মাওবাদীরাও গণ-সংগ্রাম এবং শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসুক।’’ যে দলগুলিকে ‘সুবিধাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মাওবাদীরা, সেই সিপিএম এবং সিপিআই-ও এই নয়া অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘আমরা তো আগাগোড়াই বলে আসছি, বর্তমান ব্যবস্থায় যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তা কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের যতটা সম্ভব কষ্ট লাঘব করা উচিত এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণ-আন্দোলন জরুরি। অস্ত্র ছেড়ে ওরা সেটা করলে সামগ্রিক ভাবে বামপন্থার মঙ্গল হবে।’’ সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক প্রবোধ পণ্ডা বলেন, ‘‘আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বিপ্লবের চিন্তা সঠিক নয়। ওরা গণ-আন্দোলনে আসুক। অস্ত্রে নয়, মানুষে আস্থা রাখুক।’’