রাজ্যে ফের সংগঠন চাঙ্গা করতে মরিয়া মাওবাদীরা। ফাইল চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, জঙ্গলমহল হাসছে। এক সময়ের লালদুর্গ পুরোপুরি তৃণমূলের গড়ে পরিণত হয়। তৃণমূলের সেই হাসি কেড়ে নিয়েছিল বিজেপি— গত পঞ্চায়েত এবং লোকসভা নির্বাচনে। জঙ্গলমহলে ক্ষমতা পাওয়া এই দুই রাজনৈতিক দলকেই এ বার আক্রমণ করল মাওবাদীরা। বাংলার রাজনীতি নিয়ে ফের সরব হল মাওবাদী সংগঠন। আদিবাসী-জনজাতির মানুষদের মধ্যে হিন্দুত্ব ছড়াতে চাইছে বিজেপি। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি প্রসঙ্গে বিজেপি নিয়ে বিশেষ উল্লেখ নেই। তবে তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। যে কোনও বিরুদ্ধ কণ্ঠ রুখতে দমন-পীড়নে পূর্বসূরি বামফ্রন্টের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকার। আট বছর পর নীরবতা ভেঙে এই ভাষাতেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের সমালোচনা করলেন মাওবাদী সংগঠনের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর সম্পাদক কিষাণ। সেই সঙ্গে জোর দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে নিজেদেরকে শরিক করার।
মাওবাদীদের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর সম্পাদক হিসাবে সম্প্রতি কিষাণ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁদের পূর্বাঞ্চলীয় মুখপত্র ‘লাল চিঙ্গারি’ পত্রিকায়। পূর্বাঞ্চলীয় বুরো বা সিপিআই মাওবাদী সংগঠনের ইস্টার্ন রিজিওনাল ব্যুরোর উপরেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং অসম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের দলীয় সংগঠন পরিচালনার ভার। লালগড় আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড কোটেশ্বর রাও-ও ছিলেন এই পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর শীর্ষ নেতা।
সাম্প্রতিক ওই সাক্ষাৎকারে মাওবাদী নেতা কিষাণ, পূর্বাঞ্চলের অন্য রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে অনেকটাই গুরুত্ব দিয়েছেন এ রাজ্যকে। ওই শীর্ষ মাওবাদী নেতার আক্রমণের লক্ষ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কড়া সমালোচনা করে কিষাণ বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর শাসনে। তিনি কোনও ধরনের সমালোচনা, অসন্তোষ শুনতে রাজি নন। তাঁর শাসনে গণতন্ত্রের কোনও জায়গা নেই।” ওই মাওবাদী নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালকে তাঁর পূর্বসূরি সিপিএমের সঙ্গেই তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘বামফ্রন্ট আমলে লালগড় এবং পাহাড়ের আন্দোলনকে যে ভাবে দমনমূলক আইন এবং রাষ্ট্রীয় দমন নীতি দিয়ে পায়ের তলায় পিষে দেওয়া হয়েছিল, মমতাও সেই একই পথের পথিক। বরং বামফ্রন্টের থেকে তিনি আরও এগিয়ে এই ব্যাপারে।” তৃণমূলের নীতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে বলে দাবি ওই গেরিলা নেতার। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল শাসনকালে জনস্বার্থে আদৌ কিছু হয়নি, সবটাই ভাঁওতা।’’
গত ১৫ অগস্ট বেলপাহাড়ি থানা এলাকায় মাওবাদীদের নামাঙ্কিত পোস্টার পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত।
রাজ্য গোয়েন্দা শাখার শীর্ষ আধিকারিকদের একাংশের দাবি, গণপতির হাত থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সংগঠনের খোলনলচে বদলাচ্ছিলেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজ। কোটেশ্বর রাওয়ের মৃত্যুর পর গোটা পূর্বাঞ্চলে সংগঠন ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছিল। সেই সংগঠন বাসবরাজ ফের চাঙ্গা করেছেন নেতৃত্বে বেশ কিছু বদল এনে। ওই সাক্ষাৎকারে যে ভাবে বাংলার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে গোয়েন্দাদের ধারণা, এ রাজ্যেও ফের সংগঠন চাঙ্গা করতে মরিয়া মাওবাদী সংগঠন। রাজ্য গোয়েন্দা শাখার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘২০১১ সালে কোটেশ্বর রাওয়ের মৃত্যুর পর থেকে পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো এ রাজ্য নিয়ে কার্যত নীরব ছিল। এ রাজ্যে পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর কোনও ধরনের সক্রিয়তা দেখা যায়নি। প্রায় আট বছর পর সেই পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো ফের সরব এ রাজ্য নিয়ে। এটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।”
আরও পড়ুন: শাশুড়ি-জামাইদের গ্যাং, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সাফ ৩৫ লাখ!
কিষাণ তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ এবং আন্দোলন হচ্ছে। সেই আন্দোলনগুলোকে ব্যবহার করার প্রসঙ্গ তুলে ওই মাওবাদী নেতা বলেছেন, ‘‘আমরা জানি যে, ওই সমস্ত আন্দোলনের সঙ্গে হয়তো আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের মিল নেই। অনেক আন্দোলন ঘিরেই রয়েছে কিছু মানুষের ব্যক্তি স্বার্থ, ভোটের রাজনীতি।” কিষাণের কথায়, ‘‘তাই বলে আমরা সেই আন্দোলনকে অস্পৃশ্য ভাবব না। কারণ সাধারণ মানুষ আন্দোলনের সেই স্বার্থান্বেষী শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত নন। তাই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে ওই আন্দোলনের শরিক হয়ে তার অভিমুখ ঠিক করতে হবে।”
দীর্ঘ দু’দশক ধরে মাওবাদী আন্দোলনের উপর নজর রাখা এক গোয়েন্দা কর্তার মতে, কিষাণের এই বয়ান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রকাশ্যে এত দিন মাওবাদী নেতৃত্ব অনেক আন্দোলনকেই ভোটের রাজনীতির ধান্ধাবাজি বলে সেগুলো থেকে নিজেদের দূরে রাখতেন। এখন কিন্তু সেই আন্দোলনেও শরিক হওয়ার কথা ঘোষণা করছেন ওঁরা। সামনেই বিহার এবং আমাদের রাজ্যে নির্বাচন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মাওবাদীদের এই ঘোষণা যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী।”
গোয়েন্দাদের নজরে এসেছে আরও একটি বিষয়। গোটা সাক্ষাৎকার পর্বে কোথাও ওই মাওবাদী নেতা কোটেশ্বর রাওয়ের কথা উল্লেখ করেননি। গোয়েন্দাদের ধারণা, এ রাজ্যে কোটেশ্বর রাওয়ের রাজনীতির ছায়া থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইছেন এই নেতৃত্ব। কিষাণের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, ছোট ছোট আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে চাইছে মাওবাদীরা। এটাকেই বিপজ্জনক বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
এবার কিষেণজি (ছবিতে) নয়, এ রাজ্যে মাওবাদী সংগঠনের দায়িত্বে কিষাণ। ফাইল চিত্র।
পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর নেতৃত্বে কারা এসেছেন তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে গোয়েন্দাদের মধ্যে। সিপিআই মাওবাদী সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রশান্ত বসু আগে ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর প্রধান। তবে গোয়েন্দাদের দাবি, বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি নিষ্ক্রিয়। বাসবরাজ সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশান্ত বসুকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে খবর গোয়েন্দাদের কাছে। তবে তিনি কে তা নিয়ে ধন্ধে রয়েছেন গোয়েন্দারাও। কিছু দিন আগে তাঁদের কাছে খবর ছিল, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রঞ্জিৎ বসুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সেই তথ্য ভুল বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। বর্ষীয়ান সংগঠক মিসির বেসরা বা প্রমোদ মিশ্রও দায়িত্ব পেতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না তাঁরা।
তবে, একটি বিষয়ে গোয়েন্দারা একমত— ফের পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনের রাজ্য কমিটি গঠন করে জঙ্গলমহলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মাওবাদীরা। আর হারানো জমি ফেরত পেতে স্থানীয় ইস্যুকে কাজে লাগাতে মরিয়া তারা। সম্প্রতি জঙ্গলমহলের গ্রামে মাওবাদী স্কোয়াডের আনাগোনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ফের সেখানে নতুন কোনও আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করছে গেরিলারা।
আরও পড়ুন: ক্ষুদিরাম ‘দুষ্কৃতী’, বিক্ষোভ বাংলায়
গোয়েন্দাদের আশঙ্কার আরও কারণ রয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের এক শীর্ষ আধিকারিক বলছেন, ‘‘জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের প্রত্যাবর্তন রুখতে প্রতি গ্রামে একাধিক যুবককে ভিলেজ পুলিশের চাকরি দেওয়া হয়েছে। তার পরেও মাওবাদী স্কোয়াডের আনাগোনার খবর অনেক পরে পেয়েছে পুলিশ। আর সেটাই সব চেয়ে চিন্তার বিষয়।”