প্রতীকী ছবি।
প্রধানত প্রাচীন গ্রিক, ল্যাটিন বা সংস্কৃত ধ্রুপদী সাহিত্যের পাঠ মেলে ধরতেই এমন চেষ্টা দেখা গিয়েছে। তুলসীদাসী রামায়ণ, গুরু নানক, সুরদাস, আবুল ফজ়লের রচনা বা উর্দু গজ়ল কি সুফি কাব্যের ক্ষেত্রেও এমন নিদর্শন রয়েছে। তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়েও যে এমন প্রকল্প হতে পারে, তা সে-ভাবে কেউই ভাবেননি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের প্রকাশনায় বাংলা সাহিত্যের কিছু সেরা সম্ভার নিয়ে দ্বিভাষিক সটীক প্রামাণ্য সংস্করণ তৈরির একটি প্রকল্প অবশেষে জন্মের আলো দেখতে চলেছে।
‘‘আশা করা যায়, দু’-এক বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি বাংলা বইয়ের দ্বিভাষিক সংস্করণ (বাংলা ও ইংরেজি) প্রকাশিত হবে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন ‘কালান্তর’ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’— এই তিনটি বইয়ের সংস্করণ তৈরির কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে’’, বলে বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি সিরিজ়’ প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে থাকা অধ্যাপক তথা সাহিত্য তত্ত্ববিদ গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তী। গায়ত্রী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক তথা স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডসের অধিকর্তা অভিজিৎ গুপ্ত, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিশারদ তিবো দ্যু’বের প্রমুখ এই সিরিজ়টির সম্পাদনায় শরিক বলে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেসের তরফে জানানো হয়েছে। প্রথম তিনটি বাংলা বইয়ের সংস্করণ প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছেন তরুণ বাঙালি শিল্পোদ্যোগী তথা কলম্বিয়া বিজ়নেস স্কুলের প্রাক্তনী রুদ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবা দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের সম্মাননায় এই কাজটি করছেন রুদ্র।
বাংলা সাহিত্য বিষয়ক বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক সিরিজ়টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে শঙ্খ এবং গায়ত্রীর প্রস্তাবনাতেই প্রকল্পটি দানা বাঁধে। গায়ত্রী বলছিলেন, ‘‘হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের লোব ক্লাসিক্যাল লাইব্রেরির ধাঁচে বাংলা সাহিত্য নিয়ে এই প্রকল্পটি চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য নিয়ে হার্ভার্ডের কাজটি শুরু হয়েছিল বিশ শতকের গোড়ায়। তা এখনও চলছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্ভার নিয়ে প্রকল্পটিরও ধরাবাঁধা সময়সীমা নেই। বাংলার কয়েক শতকের মননের ধারা নিয়ে কাজটায় চর্যাপদ থেকে আধুনিক যুগের সাহিত্যও থাকবে।’’ প্রতিটি সংস্করণে মূল বাংলা পাঠ, ইংরেজি তর্জমা এবং সবিস্তার টিকা থাকবে। সঙ্গে থাকবে বইটির বিশ্লেষণধর্মী মুখবন্ধ (ক্রিটিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন)। গায়ত্রীর কথায়, ‘‘সারা দুনিয়ায় ইংরেজির যা দাপট, তাতে বিপুল বাংলা ভাষাভাষী থাকলেও বাঙালি মননের এ সব উৎকর্ষ স্মারক আর দু’-এক প্রজন্মে হারিয়ে যেতে পারে। বাংলা ভাষাভাষী ও সমকালীন বিশ্বের কাছে বাংলা সাহিত্যের কীর্তিগুলি পৌঁছে দেওয়া তাই জরুরি।’’
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেসের তরফেও ভারতের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল মনন ও মানবতার চারণভূমি হিসেবে বাংলার সাহিত্যধারা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মূর্তি ক্লাসিক্যাল লাইব্রেরির প্রকল্পে কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় প্রাচীন বা মধ্য যুগের সাহিত্যের দ্বিভাষিক সংস্করণ বেরিয়েছে। যাদবপুরের অধ্যাপক অভিজিৎ গুপ্ত বলছিলেন, ‘‘তাতে অন্নদামঙ্গলের সংস্করণ বেরিয়েছিল। কিন্তু বাংলায় এর বেশি দ্বিভাষিক সংস্করণের কাজ হয়েছে বলে জানা নেই। আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে তো এমন কাজ আগে হয়ইনি!’’