বিচার চেয়ে: দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের দু’বছর পরে দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজধানীর পথে মোমবাতি মিছিল। ফাইল চিত্র
২০০৪-এর পরে ২০২০। কলকাতার পরে দেশের রাজধানী দিল্লি।
১৬ বছর পরে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ফাঁসি হল অপরাধীর। তবে এ বার শুধু ধর্ষণ নয়। গণধর্ষণ। আর ফাঁসিকাঠেও এক জন নয়, ঝোলানো হল চার জনকে। দিল্লির ২৩ বছরের এক তরুণীকে প্রথমে গণধর্ষণ এবং অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের পরে বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ওই অপরাধীরা। যার জেরে পরে মারা যান তিনি।
তিহাড় জেলে ওই ধর্ষক-খুনিদের ফাঁসির পরে এ রাজ্যের ধর্ষণের বিভিন্ন মামলার কী অবস্থা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। গত কয়েক বছরে কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলাতেও একের পর এক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। যার মধ্যে রয়েছে ২০১৫ সালের মার্চে রানাঘাটের এক বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর গণধর্ষণের ঘটনাও। একটি খ্রিস্টান মিশনের ৭১ বছরের ওই সন্ন্যাসিনীকে গণধর্ষণ করেছিল দুষ্কৃতীরা। সিআইডি সেই মামলার তদন্তভার নিয়েছিল। ওই ঘটনায় নাজিমুল, মুকেশ আলম এবং
মহম্মদ মাজিদ-সহ মোট ছ’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় নাজিমুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক। বাকিদের দশ বছরের সাজা হয়। কিন্তু তার মধ্যেও এ রাজ্যের বাসিন্দা গোপাল সরকার সম্প্রতি হাইকোর্টে আবেদন করলে তাকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে দুষ্কৃতীদের আশ্রয় দেওয়া ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ছিল।
২০১২ সালে এ রাজ্যে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের গণধর্ষণ-কাণ্ড। ওই ঘটনায় তিন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিলেও মূল দুই অভিযুক্ত, আজহার ওরফে মহম্মদ আলি এবং কাদের খানের বিচার প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। একই ভাবে কামদুনি গণধর্ষণ মামলাও বিচার প্রক্রিয়াতেই আটকে রয়েছে। ওই মামলায় অভিযুক্ত আট জনের মধ্যে ছ’জনের শাস্তি ঘোষণা করে আদালত। তিন জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি তিন জনের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় নিম্ন আদালত। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া তিন অভিযুক্ত। এ বিষয়ে আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় জানান, দিল্লির ঘটনার ক্ষেত্রে নির্যাতিতার পরিবারের লোকজন শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছেন। অনেকের সমর্থন ও সহযোগিতাও পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কামদুনির ঘটনার ক্ষেত্রে হাইকোর্টে মামলাটি পড়ে রয়েছে। শুনানি হলেও অভিযুক্তেরা হাল ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। তাই এই মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রানাঘাট, পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনিই নয়, গত কয়েক বছরে আরও কয়েকটি ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যে। যার মধ্যে রয়েছে মধ্যমগ্রামের গণধর্ষণ বা বীরভূমের আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের মতো ঘটনাও। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আদতে বিহারের বাসিন্দা এক ট্যাক্সিচালকের বছর ষোলোর মেয়েকে মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে একটি খালি জায়গায় ফেলে দিয়ে যায় পড়শি এক যুবক-সহ পাঁচ জন। পরের দিন সকালে ওই কিশোরীকে বাড়ির লোকজন উদ্ধার করে। নিগৃহীতা কিশোরী ও তার বাবা মধ্যমগ্রাম থানায় অভিযোগ দায়ের করে ফেরার পথে মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় অভিযুক্তেরা। একটি ট্যাক্সিতে তুলে ফের তাকে গণধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। দ্বিতীয় বার গণধর্ষণের পরে ওই কিশোরীকে মধ্যমগ্রাম স্টেশনে এনে রেললাইনের উপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। তার চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এলে অভিযুক্তেরা পালায়। অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নেমে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। পরে মামলা চলাকালীন ওই কিশোরী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। কিশোরীর বাবার অভিযোগ ছিল, তাঁর মেয়েকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে ওই ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া চলে এবং ২০১৪ সালে আদালত পাঁচ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।
রয়েছে বীরভূমের লাভপুর থানা এলাকায় বছর কুড়ির এক আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনাও। সেই মামলায় ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। অন্য জাতের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ‘অপরাধে’ ওই তরুণীর বিচার করতে গ্রামপ্রধানের নেতৃত্বে সালিশি সভা বসেছিল। সেখানে জরিমানার টাকা দিতে না পারায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েক জনকে বলা হয় ওই তরুণীকে ধর্ষণ করতে। খোদ গ্রামপ্রধান, যে সালিশি সভার নেতা ছিল, সে-ও ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে। পরে অভিযুক্ত ১৩ জনকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।