এই সেই নির্দেশিকা। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যের সব দফতরের ‘গ্রুপ এ’ অফিসারদের প্রতি আর্থিক বছরের শেষে নিজস্ব কাজের মূল্যায়ন (সেল্ফ অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট বা ‘সার’) জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা অনেকেই মানছেন না। সরকারি নিয়মে নিজস্ব কাজের মূল্যায়নের সঙ্গে ফি-বছর অফিসারদের সম্পত্তির হিসাবও অনলাইনে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু অর্থ দফতরের তরফে বার বার চিঠি দেওয়া হলেও অনেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না। কেউ কেউ বছরের পর বছর ওই রিপোর্ট জমা করেননি। গত মে মাসেই অর্থ দফতরের চিঠি পেয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ‘গ্রুপ এ’ স্তরের কর্তাদের বকেয়া বছরগুলির মূল্যায়ন জমার নির্দেশ দেয়। নিয়ম না মানলে পদোন্নতি থেকে অন্যান্য সুবিধা মিলবে না বলে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও বেশির ভাগ অফিসারই নিয়ম মানেননি বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকেই অনলাইনে নিজেদের ‘মূল্যায়ন’ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় নবান্ন। তাতে ২০১৮-’১৯ আর্থিক বছরের শেষ থেকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। নবান্ন সেই সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করে ২০১৮ সালের ৬ মে। ওই নির্দেশে বলা হয়েছিল, একটি আর্থিক বছরে এক জন অফিসার কত দিন কাজ করেছেন, কত দিন ছুটিতে ছিলেন, কত দিন দেরিতে দফতরে এসেছেন, সেই কারণে কত ছুটি কাটা গিয়েছে— সব জানাতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি কী ধরনের কাজ করেছেন, সময়ের মধ্যে সেই কাজ শেষ হয়েছে কি না এবং অতিরিক্ত কোনও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে কি না, তা-ও জানাতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে প্রতিটি অর্থবর্ষের শেষে অফিসারের সম্পত্তির হিসাব। নবান্নের নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র তিনটি কারণে ওই রিপোর্ট জমা না দিলেও চলে। এক, যদি কোনো অফিসার কোনও আর্থিক বছরের পুরো সময়টাই ছুটিতে থাকেন। দুই, কেউ যদি ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ থাকেন বা ‘সাসপেন্ডেড’ (নিলম্বিত) হয়ে থাকেন এবং তিন, কোনও অফিসার যদি আর্থিক বছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কাজে যোগ দিয়ে থাকেন। রাজ্য স্তরের সরকারি দফতরের পাশাপাশি জেলা বা ব্লক স্তরে যুক্ত গেজ়েটেড অফিসারেরাও সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সচিব পদমর্যাদার অফিসার থেকে ব্লক আধিকারিক (বিডিও) পর্যন্ত যে কোনও ক্যাডারের আমলাদের ওই বার্ষিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা।
সে সব নিয়ম যে মানা হচ্ছে না, তা জানিয়ে স্বাস্থ্য দফতর গত ২১ মে একটি নোটিশ জারি করে। তাতে ২০১৮-’১৯ থেকে ২০২২-’২৩ পর্যন্ত একটি অর্থবর্ষেও যাঁরা রিপোর্ট জমা দেননি, তাঁদের সতর্ক করা হয়। গোটা প্রক্রিয়া আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করা হবে বলেও জানানো হয়। ওই নির্দেশের পরে কত জন বকেয়া রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, তা জানা না গেলেও ‘সমস্যা’ যে রয়েছে, তা স্বীকার করছেন স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা। তবে তাঁদের দাবি, অফিসারেরা ঠিকঠাক কাজ করেননি বলে রিপোর্ট জমা পড়েনি তা নয়। অনেকেই এ ব্যাপারে ‘বেখেয়ালি’। কেউ ভুল করে জমা দেননি। এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, ‘‘আসলে অনেকেই সার্ভিস রুল ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেন না। অনেকে জমা দিতে গিয়ে অসুবিধারও সম্মুখীন হয়েছেন। তাই আমরা পুরনো অফিসারদের বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাচ্ছি। যাতে তাঁরা সকলে ওই নিয়ম মেনে চলেন। একই সঙ্গে নতুন যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব এবং প্রাপ্য সম্পর্কে শেখানোয় উদ্যোগী হয়েছি।’’ এ বার যাতে সকলে নিজস্ব রিপোর্ট জমা করেন, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা সতর্ক বলেও জানা গিয়েছে।
তবে প্রশাসনের একাংশের দাবি, ওই রিপোর্ট জমা না দেওয়ার আড়ালে ‘অন্য কারণ’ রয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারি কর্তাদের একাংশ পদোন্নতি চান না। কারণ, তাঁরা কোনও একটি পদে দিনের পর দিন থেকে যেতে চান। সেই কারণে নিজস্ব মূল্যায়ন জমা দিতে অনীহা দেখান। শুধু স্বাস্থ্য দফতরই নয়, অন্যত্রও এমন অফিসার রয়েছেন বলেও দাবি ওই মহলের। শাসকদলের রাজ্য সরকারি কর্মীদের সংগঠন তৃণমূল কর্মচারী ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনোজ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমিও অবসরের আগে ‘গ্রুপ এ’ অফিসার ছিলাম। তখন হাতে হাতে ওই রিপোর্ট জমা দিতে হত। তখনও অনেকে নিয়মিত সেটি জমা দিতেন না। এখন অনলাইনে জমা দেওয়ার সুবিধা থাকলেও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলেই শুনেছি।’’ বিষয়টিকে অফিসারদের কর্মসংস্কৃতির ‘অবক্ষয়’ বলে দাবি করে মনোজ বলেন, ‘‘কর্মীদের পদোন্নতির একটি শৃঙ্খল থাকে। এক জন একই পদে দীর্ঘ দিন থেকে গেলে অন্যের পদোন্নতি আটকে যায়। তাই এটা নিয়মিত জমা করা উচিত। কিন্তু কেউ কেউ একই পদে থেকে যেতে চান নানা স্বার্থে।’’
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক করেছেন, অফিসারদের কাজের মূল্যায়ন রিপোর্টের উপরে তিনি নিজে নজরদারি করবেন। নবান্ন সূত্রের খবর, আমলাদের কাজের বার্ষিক মূল্যায়নের উপরে নম্বর দেওয়ার আগে তাঁকে যেন জানানো হয় বলে মুখ্যসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিককে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। আমলাদের নিজস্ব কাজের মূল্যায়নের উপরে ভিত্তি করেই ঊর্ধ্বতনেরা ‘অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট’(এসিআর) তৈরি করেন। সেটা দেখেই নবান্ন সংশ্লিষ্ট অফিসারদের পদোন্নতি বিবেচনা করে।