—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ঘটনা ১: জ্বরের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল তিন বছরের শিশুকে। শরীরে ক্ষত দেখে এক্স-রে করানো হয়। রিপোর্ট দেখে চোখ কপালে চিকিৎসকদের। ছোট্ট শরীরের ভিতরে বিঁধে রয়েছে সাতটি সুচ। কয়েক দিন পরে মৃত্যু হয় পুরুলিয়ার সেই শিশুর। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, মা ও তাঁর ‘প্রেমিকের’ সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল শিশুটি। তাই এই পরিণতি।
ঘটনা ২: দোকানে বিস্কুট কিনতে গিয়েছিল বছর পাঁচের ছেলেটি। ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যায়। বীরভূমের শান্তিনিকেতনের মোলডাঙা এলাকায় দিন তিনেক পরে পাশের বাড়ির ছাদে মেলে তার বস্তাবন্দি দেহ। তদন্তে জানা যায়, পড়শিদের মধ্যে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে খুদে।
ঘটনা ৩: খেলার ছলে পড়শির বাড়িতে গিয়েছিল বছর চারেকের শিশু। গত ১৭ অক্টোবর নদিয়ার শান্তিপুরে সেই বাড়ির এক যুবক তার হাত-পা বেঁধে দীর্ঘ ক্ষণ পিঁপড়ের ঢিবির উপরে বসিয়ে রেখে দেয় বলে অভিযোগ। পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। জানা যায়, দুই পরিবারের বিবাদে আক্রোশ মেটাতে এই ঘটনা।
গত কয়েক বছরে যৌন হেনস্থার পাশাপাশি শিশুদের উপরে অন্য ধরনের নির্যাতনের এমন বহু ঘটনা সামনে এসেছে রাজ্যে। ঘটনাগুলির মধ্যে মিল: বড়দের সম্পর্ক অথবা বিবাদের শিকার হয়েছে শিশু। কখনও পরিবারের কারও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, কখনও আত্মীয়দের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ— নানা টানাপড়েনের রোষ গিয়ে পড়েছে শিশুর উপরে। এ সবের বাইরেও, সমাজের নানা ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নাবালক-নাবালিকারা। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান মিললেও, শিশুদের উপরে অন্য নানা ধরনের অত্যাচারের বিশদ পরিসংখ্যান প্রশাসনের তরফে মেলে না। অনেক নির্যাতিতের পরিবারের দাবি, বহু ঘটনা শুধু তদন্ত প্রক্রিয়াতেই আটকে থাকে দীর্ঘ দিন, বিচার সহজে পাওয়া যায় না।
শিশুকল্যাণ সমিতির কর্মী-আধিকারিকদের অভিজ্ঞতায়, শিশু নির্যাতনের একটি বড় অংশ ঘটে তাদের নিজের বাড়িতেই। সম্প্রতি যেমন মেদিনীপুরে একটি শিশু ‘অত্যাচারিত’ হচ্ছিল সৎ বাবার হাতে। সে কথা স্কুলের শিক্ষকদের জানান তার মা। সন্তানকে হোমে রাখার আর্জি জানান তিনিই। জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ ও শিশু সুরক্ষা দফতর সেই ব্যবস্থা করে। কোচবিহারের চান্দামারি গ্রামে আট বছরের এক শিশুর উপরে তার বাবা-মায়ের অত্যাচারের কথা চাইল্ড লাইনে ফোন করে জানান এক পড়শি। শিশু সুরক্ষা দফতরের কর্মীরা বাড়িতে গেলে বাবা-মা দাবি করেন, তাঁরা এটাই শাসন বলে মনে করেন। শুধু কোচবিহারে বছরে গড়ে শিশুদের উপরে অত্যাচারের ১৫-২০টি অভিযোগ জমা পড়ে। জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক স্নেহাশিস চৌধুরী বলেন, “পড়ুয়াদের মানসিক ও শারীরিক শাস্তি যে নিষিদ্ধ, এ বিষয়ে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।”
নাবালক-নাবালিকা অপহরণ ও নিখোঁজের বহু নালিশও জমা পড়ে পুলিশের কাছে। অনেক অভিভাবকের অভিজ্ঞতা, এমন অভিযোগে পুলিশ গোড়ায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায় না। নাবালিকা নিখোঁজের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ধরে নেওয়া হয়, ‘প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে’ সে। অনেক ক্ষেত্রে আবার কিছু দিন অপেক্ষা করে দেখার পরামর্শও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পূর্ব বর্ধমানের রায়নায় বছর দুয়েক আগে এক নাবালিকা নিখোঁজ হয়ে যায়। হাই কোর্ট এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। এখনও হদিস মেলেনি মেয়েটির। বিভিন্ন জেলায় নাবালিকা নিখোঁজের ঘটনায় ইদানীং ফোনের ‘টাওয়ার লোকেশন’ দেখে উদ্ধারে বেশ কিছু সাফল্য মিলেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
খারাপ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আঁচ নানা ভাবেই পড়ে শিশুদের উপরে। দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে বা ভোট পরবর্তী হিংসায় শিশুর মৃত্যু বা জখম হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। চলতি বছরেই লোকসভা ভোটের পরে হাওড়ার শ্যামপুর, মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার মতো কয়েক জায়গায় রাজনৈতিক হিংসায় আক্রান্ত হয়েছে শিশুরা। মাঠে বা খড়ের গাদায় পড়ে থাকা বোমা বল ভেবে খেলতে গিয়ে বিস্ফোরণে জখম বা মৃত্যু— এমন ঘটনা অজস্র। বছর দুয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় এক নেতার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তাঁর ৯ বছরের ভাগ্নি। সেখানে খড়ের মধ্যে রাখা বোমা বল ভেবে খেলতে গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় মেয়েটির। গ্রেফতার হন নেতা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি থেকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর বা মালদহের মানিকচক, বোমা ফেটে শিশুর মৃত্যু বা জখম হওয়ার সাক্ষী বহু জায়গা।
বিভিন্ন ঘটনার পরে এলাকায় বিক্ষোভ-অবরোধ হয়। অনেক সময়ে অভিযুক্ত গ্রেফতারও হয়। অনেক ক্ষেত্রে পকসো ধারায় মামলা রুজু হয়। কিন্তু বিচার সহজে মেলে না, দাবি বহু অভিভাবকেরই। চলতি বছরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পূর্ব বর্ধমানে পকসো ধারায় মামলা হয়েছে ১১৫টি। মুর্শিদাবাদে ১৫২টি। বহরমপুরের প্রবীণ আইনজীবী পীযূষ ঘোষ বলেন, “জেলা আদালতে সারা বছর যত মামলা হয়, তার ২০-২৫ শতাংশের নিষ্পত্তি হয়। পকসো মামলার নিষ্পত্তির হার আরও কম।” পুলিশের দাবি, শিশু নির্যাতন রোধে বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়া হয়। অত্যাচারিত হলে কী করণীয়, কোথায় তা জানাতে হবে, সেই পাঠ দেওয়া হয়। অনেক স্কুলে আত্মরক্ষার কৌশলও শেখানো হয়।
তবে এই উদ্যোগ যে শিশু নির্যাতন রোধে যথেষ্ট নয়, একের পর এক ঘটনাই তার প্রমাণ।