দীপক জোশীর ক্ষতিপূরণের টাকা নেপাল দূতাবাসের প্রতিনিধির হাতে তুলে দিচ্ছেন এডিজি কারা পীযূষ পান্ডে এবং আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
দীর্ঘ ১২ বছর পরে বেকসুর খালাস পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন, এই এতগুলো বছর আমাকে কে ফিরিয়ে দেবে ?
সেটা ছিল সিনেমার পটভূমি। অগ্রদূত পরিচালিত সেই বাংলা ছবি ‘সবার উপরে’-তে ছবি বিশ্বাসের ছেলে উত্তমকুমার খুনে অভিযুক্ত, অথচ নিরপরাধ বাবার পক্ষে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে তাঁকে জেল থেকে বার করে এনেছিলেন।
আর দীপক জোশী জেল খেটেছেন ৪১ বছর। তিনি নিরপরাধ কি না, তা-ও প্রমাণ হয়নি। কারণ, তাঁর মানসিক অবস্থার কারণে এত বছর ধরে তাঁর বিচারই হয়নি। তাঁর হয়ে লড়াই করার মতো কেউ ছিলেনও না। কলকাতার একটি জেলের অন্ধ কুঠুরির মধ্যে মাথা নিচু করে এতগুলো বছর কাটিয়েছেন তিনি। আপাতত তিনি মুক্ত।
নেপালের বাসিন্দা দীপককে মুক্তি দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। তিনি ফিরে যান মায়ের কাছে, পূর্ব নেপালের ঝাপা-য়। কয়েক দিন আগে মারা গিয়েছেন তাঁর নবতিপর মা। আর বিনা বিচারে এত বছর আটকে রাখার জন্য বুধবার দীপককে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দীপকের হয়ে লড়াই করা আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে এডিজি (কারা) পীযূষ পান্ডে সেই টাকা তুলে দেন নেপালের দূতাবাসের প্রতিনিধির হাতে।
৪১ বছর বিনা বিচারে আটকে রাখার ক্ষতিপূরণ মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা?
জয়ন্তবাবু বলেন, “এই বিষয়ে আমাদের মধ্যেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখা গিয়েছে, এই ধরনের ক্ষেত্রে এর থেকে বেশি ক্ষতিপূরণের সংস্থান নেই আইনে। এটাই সর্বাধিক।”
নেপাল থেকে চাকরির আশায় দার্জিলিঙে চলে আসা যুবক দীপকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হয় ১৯৮০ সালের মে মাসে। অভিযোগ, বচসা চলাকালীন এক ব্যক্তিকে তিনি খুন করেন। গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর পরে দীপক মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। জয়ন্তবাবু বলেন, “অনেক সময়েই এই ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দিদের বিচার প্রক্রিয়া থমকে যায়।” বিচারাধীন বন্দি হিসেবে বছরের পর বছর জেলে পড়ে থাকতে হয়েছে দীপককেও।
২০২০-এর নভেম্বরে ছাড়া পাওয়া অন্য এক বন্দি মারফত দীপকের কথা জানতে পারেন ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস। খবর প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। দীপকের কথা জানতে পেরে কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টি বি রাধাকৃষ্ণন মামলা রুজু করার নির্দেশ দেন। আইনজীবী সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় হাই কোর্টের হয়ে এবং জয়ন্তবাবু রাজ্য লিগ্যাল সার্ভিসের হয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়েন। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়ে ৪০ বছর ১০ মাস ১০ দিন পরে ২০২১ সালের ২০ মার্চ দীপককে মুক্তি দেয় আদালত। জেল থেকে বেরিয়ে আসেন দীপক। নেপাল দূতাবাসের সহযোগিতায় তাঁকে পৌঁছে দেওয়া হয় মায়ের কাছে।
পিছনে ফেলে রেখে যান সেই অমোঘ প্রশ্ন, “এতগুলো বছর আমাকে কে ফিরিয়ে দেবে?”