দার্জিলিঙের ম্যালে এক অনুষ্ঠানে বিমল গুরুং ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র
দাবাড়ুরা বলেন ‘রানির প্যাঁচ’। কুইন্স গ্যামবিট।
বাস্তবে সম্ভবত কখনও চৌষট্টি খোপের সামনে বসেননি। কিন্তু বিমল গুরুংকে নিজের শিবিরে নিয়ে এসে দাবাড়ুদের মতো মোক্ষম চালে আসন্ন বিধানসভা ভোটে বিজেপি-র বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য রাজনীতির কারবারিদের মতে, গুরুং তৃণমূলের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করে দেওয়ায় বিজেপি নেতারা যা নিশ্চিত বলে মনে করছিলেন, তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ মমতা এবং তাঁর দাবাড়ুরা গত ৬ মাস ধরে ওই লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। এতদিনে তা ফলপ্রসূ হয়েছে। মমতার গুরুং-চাল বিধানসভা ভোটের আগে খেলা অনেকটাই তৃণমূলের অনুকূলে ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে উত্তরবঙ্গে। পরোক্ষ প্রভাব পড়বে দক্ষিণবঙ্গে।
রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে উত্তরবঙ্গে রয়েছে ৫৪টি আসন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে ওই ৫৪টি আসনের মধ্যে ৩৭টি আসনেই এগিয়েছিল বিজেপি। যে ভোটে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল খাতাই খুলতে পারেনি। ফলে বিধানসভা ভোটে মমতার লক্ষ্য থাকবে বিজেপি-র ওই ঘাঁটি ভেঙে দেওয়া। আর বিজেপি-র লক্ষ্য থাকবে ওই গড় রক্ষা করা।
আরও পড়ুন: সৌমিত্রের ঘোষিত সব কমিটি ভাঙলেন দিলীপ, ডামাডোল চরমে রাজ্য বিজেপি-তে
এমনিতে উত্তরবঙ্গের ভোটারদের জাতিগত রাজনীতি খানিকটা জটিল। একদিকে বাঙালি, অন্যদিকে নেপালি এবং আদিবাসি সম্প্রদায়ের মানুষ। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি নেপালি এবং আদিবাসি সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের সঙ্গে রাখতে পেরেছিল। যে কারণে তারা উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ আসনেই এগিয়েছিল। মমতার লক্ষ্য সেই আসনগুলির মধ্যে যথাসম্ভব বেশি আসনে তৃণমূলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। সেখানেই তাঁর গুরুং-চাল।
গুরুংয়ের প্রভাবে নেপালি ভোট তৃণমূলের ঝুলিতে আসার জোরাল সম্ভাবনা আছে বলে বিজেপি নেতারাও মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু পাশাপাশিই তাঁদের বক্তব্য, পাহাড়ে গুরুংয়ের সেই ‘নিয়ন্ত্রণ’ আর নেই। তিন বছর তিনি সেখানে না থাকায় গোর্খা ভোটের উপর তাঁর প্রভাব এখন অনেকটাই শিথিল। উল্লেখ্য, দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের সমতলের ৪টি আসনের মধ্যে চোপড়া ছাড়া প্রতিটিতেই নেপালি ভোট রয়েছে। যেমন রয়েছে আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা আসনে। অর্থাৎ, পাহাড় এবং সমতল মিলিয়ে কম-বেশি মোট ১৪টি বিধানসভা আসনে গুরুংয়ের ‘প্রভাব’ পড়ার সম্ভাবনা।
ডুয়ার্সের চা বাগানের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত বঙ্গসন্তান সুদীপ সেনের (কাল্পনিক নাম) কথায়, ‘‘সমতলের তরাই এবং ডুয়ার্সের নেপালিদের মধ্যে গুরুংয়ের একটা প্রভাব রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা এখনও প্রশ্নাতীত এবং সামগ্রিক কি না, সেটাই দেখার।’’ তবে তাঁর মতে, গুরুংয়ের সঙ্গে ভোটারদের মধ্যে ‘মমতা ফ্যাক্টর’ও কাজ করবে। কারণ, গত পাঁচ বছরে মমতা বার বার উত্তরবঙ্গে গিয়ে সেখানকার উন্নয়নের কাজে জোর দিয়েছেন।
পাহাড়ে খাদা উপহার দিয়ে অভ্যর্থনা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে।
আরও পড়ুন: রাস্তা নয়, ফোকাস মণ্ডপে, হাইকোর্টের রায় বদলে দিয়েছে পুলিশি ব্যবস্থা
প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গের দক্ষিণে মালদহ (দক্ষিণ) আসনটি লোকসভা ভোটে জিতেছিল কংগ্রেস। ত্রিমুখী লড়াইয়ে (এই আসনে বামেরা প্রার্থী দেয়নি) তাদের প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু) এগিয়েছিলেন ৪টি আসনে। আবার মালদহ (উত্তর) লোকসভা আসনের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৪টিতেই এগিয়েছিল তৃণমূল এবং কংগ্রেস। অর্থাৎ, মালদহ জেলায় মোট ৮টি বিধানসভা আসনে পিছিয়েই ছিল বিজেপি।
উত্তরবঙ্গের উত্তরের ১৪টি আসনের সঙ্গে যদি বাম-কংগ্রেস জোট মালদহের ওই ৮টি আসনেও বিজেপি-র সঙ্গে জোর লড়াই দিতে পারে, তাহলে সেই আসনগুলিতেও তৃণমূলের সম্ভাবনা বাড়বে। কারণ, গুরুংয়ের প্রভাবে উত্তরের নেপালি অধ্যুষিত আসনগুলি তাদের হাত থেকে এমনিতেই বেরিয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। ওই আসনগুলিতে বাম-কংগ্রেস তাদের ভোট ধরে রাখতে পারলে বিজেপি আরও বিপাকে পড়বে। সবমিলিয়ে উত্তরবঙ্গের বেশকিছু আসনে বিজেপি সমস্যায় পড়তে পারে। বাড়তে পারে তাদের হারের ব্যবধানও। ওই আসনগুলিতে তৃণমূল যেমন লাভ করবে, তেমনই ক্ষতি হবে বিজেপি-র। ভোটের অঙ্কে ১০ শতাংশ ভোট কমা মানে আসলে ২০ শতাংশ। রাজনীতিতে এমন ‘ডাব্ল এফেক্ট’-ই হয়ে থাকে। ফলে বিজেপি-র আসনও হাতছাড়া হবে। ভোটও কমবে।
সাধারণত দেখা যায়, কেন্দ্রে শক্তিশালী দলের ক্ষেত্রে লোকসভার ভোট যে ধাঁচে হয়, বিধানসভার ভোট সেই ধাঁচে হয় না। ফলে লোকসভা ভোটে ভোটাররা যে ধাঁচে ভোট দিয়েছিলেন, বিধানসভায় সে ভাবে দেবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
উল্লেখ্য, রাজ্যের মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৬৫টি আসনে ৪০ শতাংশের বেশি মুসলিম ভোট রয়েছে। শতাংশের হিসাব ৩০ করে দিলে যে সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১০০-র আশেপাশে। আর ২০ শতাংশ করলে সেই সংখ্যাটি পৌঁছে যাবে ১২০টি আসনে। ৪০ শতাংশ মুসলিম ভোটের হিসাবে উত্তরবঙ্গের ১২ থেকে ১৫টি আসন রয়েছে। মধ্যবঙ্গে (মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া) রয়েছে ২০ থেকে ২২টি আসন। রাঢ়বঙ্গে (হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুা, পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম) রয়েছে ২টি আসন এবং দক্ষিণবঙ্গে (দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা ও হাওড়া) রয়েছে ২৮ থেকে ৩০টি আসন।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিমল গুরুং।
আরও পড়ুন: ‘ভোলেনাথ শঙ্করা’ গানে নাচ মন্ত্রী সুজিতের, কেদারনাথ থিমে কি বিশেষ কোনও বার্তা
তৃণমূলের আশা, এই আসনগুলিতে বিজেপি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। পাশাপাশিই, গুরুংয়ের সাহায্যে আরও ১৪টি আসন যদি মমতা জিততে পারেন, তাহলে তাঁর ক্ষমতায় ফেরার পথ অনেকটাই নিশ্চিত হতে পারে।
তবে তৃণমূল গোটা বিষয়টিতেই খুব ‘সংযত’ । গুরুংয়ের সমর্থন ঘোষণার পরেও শাসকদলের তরফে কোনও ‘উচ্ছ্বাস’ দেখানো হয়নি। উল্টে তাদের প্রতিক্রিয়া খুব ‘মাপা’। কোনও নেতা নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিক্রিয়া দেননি। যেটুকু বলা হয়েছে, তা দলের তরফে। এবং সেই প্রতিক্রিয়ায় একসঙ্গে বার্তা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জিটিএ এবং পাহাড়ের নাগরিক সমাজের কাছে। যাঁদের এমনিতে গুরুংয়ের রাজনীতি এবং তাঁর পন্থা আপত্তি রয়েছে। নিয়ে এ ছাড়াও, পাহাড়ের রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ বিভিন্ন ভাবে জড়িত, তাঁদের কাছেও তৃণমূল সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছে।
তৃণমূলের এক শীর্ষনেতা শুক্রবার বলেন, ‘‘গুরুং আমাদের সঙ্গে আসায় পাহাড়ের আসনগুলো তো নিশ্চিত বটেই। বিজেপি-র কাছে পাহাড়ের ৩টে আসন হারানো মানে আসলে ৬টা আসন হাতছাড়া হওয়া। সমতলের যে আসনগুলিতে আদিবাসি প্রভাব রয়েছে, সেখানেও গুরুংয়ের আগমন এবং পাহাড়ের সমীকরণের বদল একটা মনস্তাত্বিক প্রভাব ফেলবে।’’
যে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন রাজ্য বিজেপি-র কর্মসমিতির সদস্য শিশির বাজোরিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘গুরুংয়ের তিন বছর ফেরার থাকার মামলার কী হবে? এখন কি তাঁর সাতখুন মাফ হয়ে গেল? সাব ইন্সপেক্টর খুনের মামলারই বা কী হল? আমি সেই প্রশ্নটা করতে চাই। ৪-৫টা আসনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ৩ বছর ধরে এই নাটকটা কেন করলেন? বাংলা এবং পাহাড়ের মানুষ কিন্তু এটা মেনে নেবেন না!’’
তবে শিশির যা-ই বলুন, রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা কিন্তু মনে করছেন, সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের নিরিখে উত্তরবঙ্গে বিজেপি যে ৩৭টি আসনে এগিয়েছিল, তার অর্ধেক আসন তারা হারাতে পারে। তবে তা সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের মোট ৫৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি-র প্রায় অর্ধেক আসন ধরে রাখার সম্ভাবনা। কিন্তু লোকসভা ভোটের মতো নিরঙ্কুশ প্রাধান্য তারা ধরে রাখতে পারবে না। ভোটও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা।
যাদবপুরের সিপিএম বিধায়ক তথা বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘পাহাড় এবং সমতল মিলিয়ে যে ১১টি আসনের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে যে আসনগুলি কংগ্রেস এবং বামেরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে পেয়েছিল, সেগুলি আবার তারাই পাবে। কারণ, গুরুং বিজেপি-র দিকে যাওয়ায় তাঁর লোকজন বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিল। এখন তিনি ভোল বদলে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু তাঁর লোকজন তো তৃণমূলকে পছন্দ করে না। ফলে সেই পুরনো ভোট আবার আমাদের দিকেই ফিরবে।’’
তবে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, রাজনীতিতে দুই আর দুইয়ের যোগফল সবসময় চার হয় না। রাজনীতিতে অঙ্কের সঙ্গে রসায়নও কাজ করে। তাঁদের কথায়, ‘‘সবসময় অঙ্ক মিললে তো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপকই সেরা রাজনীতিক হতেন!’’
মমতার এই চালে বিজেপি মাত হয় কি না, তা-ও দেখার। এ-ও দেখার যে, বিজেপি এর পাল্টা কোনও চাল দিয়ে কিস্তিমাত বাঁচাতে পারে কি না। কিন্তু মাত না হলেও আপাতত কিস্তি যে মমতা দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখছে না বাংলার রাজনৈতিক মহল।
কুইন্স গ্যামবিট।