ফের সঙ্ঘাতে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপাল।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতার নামে এমনিতেই উত্তাল বাংলা। তার মাঝেই আরও উত্তপ্ত হল মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের সঙ্ঘাত। রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদে জানতে মুখ্যসচিব এবং ডিজি-কে ডাকা সত্ত্বেও কেন এলেন না? এই প্রশ্ন তুলে টুইটারে রাজ্য প্রশাসনের কড়া সমালোচনায় রাজ্যপাল। আধিকারিকরা আসছেন না বলে মুখ্যমন্ত্রীকেই ডেকেছি— টুইটারে এ-ও জানালেন ধনখড়। পাল্টা পদক্ষেপে রাজ্যপালকে কড়া চিঠি পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবেন না, রাজ্য সরকারকে সহযোগিতা করুন, এই রকম কঠোর শব্দে চিঠি লিখলেন মমতা।
গত চার দিন ধরে রাজ্যে যা চলছে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতার নামে, তা নিয়ে একাধিক বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। রবিবার রাজভবন সূত্রে জানা গিয়েছিল যে, রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্রকে রাজ্যপাল তলব করেছেন। রাজ্যের পরিস্থতি সম্পর্কে বিশদ তথ্য নেওয়ার জন্যই তাঁদের ডাকা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সোমবার মুখ্যসচিব এবং ডিজি-র কঠোর সমালোচনা করে টুইট করেছেন রাজ্যপাল। তিনি জানিয়েছেন যে, মুখ্যসচিব এবং ডিজির কাছ থেকে কোনও সাড়া মেলেনি। দুই শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তার আচরণকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ও অপ্রত্যাশিত’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি। টুইটারে রাজ্যপাল লিখেছেন, ‘‘অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ্যসচিব বা ডিজি রাজ্যের বেদনাদায়ক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে এলেন না দেখে আমি বিস্মিত। পরিস্থিতির যে রকম গুরুতর, তাতে এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’
তবে রাজ্যপালের ডাকে সাড়া দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার রাজভবনে যাবেন, এমন কোনও ইঙ্গিত নবান্ন বা তৃণমূলের তরফ থেকে মেলেনি। সোমবার সন্ধ্যায় রাজ্যপালকেই বরং চিঠি পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে চিঠিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে রাজ্যপালকে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার রাজভবনে যাবেন, এমন কোনও ইঙ্গিত সেখানে দেওয়া হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি।—নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যপালকে পাঠানো চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর বয়ান যথেষ্ট কড়া। চিঠির শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘রাজ্য সরকারের এবং উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সমালোচনা করে আপনি মাঝেমধ্যেই যে সব বিবৃতি দেন বা টুইট করেন, তাতে আমি সত্যিই দুঃখিত।’’ পরের বাক্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত— যে অশান্তির বিষয়ে রাজ্যপাল বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তা শুধু পশ্চিমবঙ্গে চলছে না, গোটা দেশে চলছে। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘সারা দেশে যা চলছে, তার প্রেক্ষিতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বহাল রাখাই যে এখন রাজ্য প্রশাসনের মূল লক্ষ্য, তা আপনি নিঃসন্দেহে বুঝবেন।’’ আর চিঠির তৃতীয় বাক্যে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘যারা শৃঙ্খলা এবং শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে, তাদের প্ররোচিত করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর বদলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে রাজ্য প্রশাসনকে সহায়তা করাই সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা বলে আমার মনে হয়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির এই বাক্যে যে রাজ্যপালের প্রতি জোরদার কটাক্ষ রয়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সংশয় নেই।
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা রাজ্যপালের চিঠি।—নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রীর এই চিঠির পরে সঙ্ঘাত আরও বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজভবন ততোধিক কড়া ভাষায় পাল্টা চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সে চিঠির বয়ানও যথেষ্ট কঠোর। রাজ্যপাল লিখেছেন, ‘‘আপনার চিঠিতে আপনি যে ভাসা ভাসা অবস্থান নিয়েছেন, তাতে গভীর বেদনা এবং যন্ত্রণা পাওয়ার পাশাপাশি আমি বিস্মিত। আপনার বিশ্লেষণগুলি বাস্তব পরিস্থিতির থেকে অনেক দূরে এবং আমি আপনাকে আত্মমন্থনের অনুরোধ করব।’’
এতেই থামেননি রাজ্যপাল। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও পদক্ষেপ তিনি করেননি, যা সংবিধান বিরোধী— লিখেছেন ধনখড়। কিন্তু রাজ্যের মন্ত্রীরা বার বার আপত্তিকর ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করে তাঁকে অপমানিত করেছেন এবং রাজ্যপাল পদের মর্যাদাহানি ঘটিয়েছেন— এই অভিযোগ তুলেছেন তিনি। চিঠির শেষে তিনি আবার লিখেছেন যে, এখন এ সব বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চান না, বরং হিংসার পরিস্থিতি থেকে রাজ্যবাসীকে রেহাই দেওয়ার জন্য রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চান। মঙ্গলবার যে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে ডেকেছেন তিনি, তা আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন চিঠির শেষ লাইনে। তিনি লিখেছেন, ‘‘আগামী কাল আমাদের বৈঠকে আপনার তরফ থেকে আমি ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।’’