মমতার আলিঙ্গন। সিঙ্গুরের মঞ্চে বুধবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কৃষকের আন্দোলনের বিজয় মঞ্চ থেকেই শিল্পায়নের ডাক মমতার। টাটার হাত থেকে ফিরিয়ে আনা জমি সিঙ্গুরের যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কৃষকের হাতে তুলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই মঞ্চ থেকেই টাটা গোষ্ঠীকে অন্যত্র হাজার একর জমি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘কারখানা করতে চাইলে এক মাসের মধ্যে যোগাযোগ করুন’, সিঙ্গুরের হাজার হাজার মানুষকে সাক্ষী রেখেই আহ্বান মমতার। সিঙ্গুরের কৃষকের জন্যও এ দিন নতুন অনুদান ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চাষ শুরুর জন্য সব কৃষক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে এককালীন সাহায্য দেবে রাজ্য, ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিঙ্গুর মামলার রায় যে দিন সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছিল, সে দিন বিকেলেই সাংবাদিক সম্মেলন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ১৪ সেপ্টেম্বর উৎসব হবে সিঙ্গুরে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জোরকদমে চলছিল সেই বিজয়োৎসবের প্রস্তুতি। মুখ্যমন্ত্রীর সভার জন্য যে মঞ্চ বাঁধা হচ্ছিল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে, তা দেখেই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল সিঙ্গুরের জয়কে কত বড় করে উদযাপন করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বুধবার সকাল থেকেই সভাস্থলকে ঘিরে যে উন্মাদনা দেখা গেল সিঙ্গুরে, তা প্রত্যাশাকেও অনেকটা ছাপিয়ে গেল।
সিঙ্গুর শুধু নয়, অন্যান্য এলাকা থেকেও লোকজন এ দিন হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে। তবে সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটির মিছিল স্বাভাবিক ভাবেই এ দিন অন্য সব মিছিলের আকারকে ছাপিয়ে যায়। বেড়াবেড়ি, খাসেরভেড়ি হয়ে টাটার প্রকল্প এলাকার মধ্যে দিয়ে সভামঞ্চের দিকে এগোয় সে মিছিল। ১০ বছর হাতছাড়া থাকা জমির বুক চিরে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির এ দিনের মিছিলকে এগোতে দেখে অনেককেই আবেগবিহ্বল হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে সিঙ্গুরে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঠাসা জমায়েত জাতীয় সড়কের উপর। ছবি: পিটিআই।
উন্মাদনার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় দৃশ্যপটে ভেসে উঠতেই। সিঙ্গুরের অনেক আগে থেকে রাস্তার দু’ধারে অপেক্ষায় ছিলেন বহু উৎসাহী মানুষ। ফলে কনভয়ের গতি কিছুটা কম রেখে অপেক্ষমান জনতার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে করতে এগোতে হয়েছে মমতাকে। তিনি সভামঞ্চে পৌঁছনোর পর হুগলির জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল ছোট্ট ভাষণে সিঙ্গুরে স্বাগত জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। কৃষকদের হাতে জমির পড়চা এবং ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়ার কাজ দ্রুত শুরু করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে বিজয়োৎসবের দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে যাবেন আর সিঙ্গুরবাসীর জন্য তাঁর ঝুলিতে কোনও বিশেষ উপহার থাকবে না, তা কি হতে পারে? তাই জমির পড়চা এবং ক্ষতিপূরণের চেক পাওয়ার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আরও এক উপহার পেয়ে গেলেন সিঙ্গুরবাসী। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, নতুন করে চাষ শুরুর জন্য সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রত্যেক কৃষক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেবে রাজ্য সরকার। যত দিন না জমি চাষযোগ্য করে দেওয়া হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত যে কৃষকদের পরিবারপিছু মাসিক ২০০০ টাকা ভাতা এবং ২ টাকা কিলো দরে চালও যে মিলবে, তাও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন আবার ঘোষণা করেন।
তখন চলছে পড়চা ও চেক বিলি। মমতার পাশে মেধা পাটকরও। ছবি: পিটিআই।
তবে চমক তখনও অপেক্ষায় ছিল। নিজের ভাষণে সিঙ্গুরের আন্দোলন নিয়ে স্মৃতিচারণ শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন শিল্পায়নের প্রসঙ্গে এলেন, তখনই এল দিনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাটা। টাটাদের প্রতি সরাসরি বার্তা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বললেন, ‘‘১০০০ একর জমি নিয়ে জেদাজেদি করে টাটারা শেষ পর্যন্ত এখানে কারখানাটা করতেই পারলেন না।’’ তার পর মমতা বললেন, ‘‘আমি এই মিটিং থেকেই আজ বলে দিয়ে যাচ্ছি। এক মাস সময় দিলাম। একটু ভাবুন। গোয়ালতোড়ে আমার ল্যান্ডব্যাঙ্কে জমি আছে। ১০০০ একর জমি দেব। কেউ যদি গাড়ি কারখানা করতে চান, সে টাটাই হোক আর বিএমডব্লিউ-ই হোক, তা হলে এক মাসের মধ্যে যোগাযোগ করুন।’’ কৃষকের জমি রক্ষার আন্দোলনের বিজয় সমাবেশ মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই শিল্পায়নের ডাককে নিঃসন্দেহে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বিভিন্ন মহল। কৃষকের আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের ধাত্রীভূমি হলেও, শিল্প মহলের সঙ্গে যে তাঁর কোনও বিরোধ নেই, সে বার্তাই মমতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি বলেন, ‘‘কৃষি এবং শিল্প, কারও সঙ্গে কারও ঝগড়া নয়। দু’জনেই হচ্ছে ভাইবোন।’’ যে টাটা গোষ্ঠীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই আজ বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে মমতা, সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে সেই টাটাকেই জমি দেওয়ার বার্তা দিয়ে মমতা যে আসলে বৈরিতা বিসর্জন দিতে চেয়েছেন, তা সব মহলের কাছেই স্পষ্ট।
আরও পড়ুন: ১০ বছর পর সিঙ্গুরের কৃষকের হারানো জমি ফিরিয়ে দিলেন মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে এ দিন রাজ্যের প্রায় গোটা মন্ত্রিসভা তো ছিলই। ছিল সুশীল সমাজের এক বিরাট অংশও। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে মমতার উত্তাল আন্দোলনের দিনে যে শিল্পী-বিদ্বজ্জন-মানবাধিকার কর্মীদের দেখা যেত মমতার পাশে, তাঁদের বড় অংশকেই এ দিন সিঙ্গুরের মঞ্চে দেখা গিয়েছে। যোগেন চৌধুরী, দেব, অর্পিতা ঘোষ, ইন্দ্রনীল সেনরা দলের সাংসদ। তাঁদের উপস্থিতি প্রত্যাশিতই ছিল। সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কবীর সুমন, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, শুভাপ্রসন্ন, শাঁওলি মিত্র, মেধা পাটকর এবং আরও অনেকে। এঁদের কেউ কেউ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মমতার সঙ্গে ছিলেন। কেউ কেউ একটু সরে ছিলেন মাঝখানে। কিন্তু বুধবার সিঙ্গুরের মঞ্চ এ বাংলার সুশীল সমাজের এক বিরাট অংশকে আরও এক বার মমতার বৃত্তে দাঁড় করিয়ে দিল।
জাতীয় সড়কে ধর্না মঞ্চ বেঁধে ২০০৮ সালে এক মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন মমতা। আট বছর পর সেই জাতীয় সড়কেই সভামঞ্চ বেঁধে তিনি আবার এক মাস্টারস্ট্রোক দিলেন।