স্বাস্থ্য নিয়ে নয়া বিতর্ক উস্কে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী

বন্যায় ত্রাণের অঙ্ক নিয়ে বিতর্কটা ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হল বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে দাবি। গত শনিবার নবান্নে সর্বদলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিলিতে মোট ৯৯২ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪০
Share:

দিল্লির পথে। সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ ঘোষ

বন্যায় ত্রাণের অঙ্ক নিয়ে বিতর্কটা ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হল বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে দাবি।

Advertisement

গত শনিবার নবান্নে সর্বদলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিলিতে মোট ৯৯২ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য। সে দিনই বিরোধীরা ওই পরিমাণ টাকা খরচের হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কোথায়, কত টাকা খরচ করা হয়েছে, বিরোধীরা সেই হিসেব খতিয়ে দেখার কথা বললেও মুখ্যমন্ত্রী তা মানেননি। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যেই সোমবার রাজ্যের বন্যার জন্য ত্রাণের টাকা চাইতে দিল্লি যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী বন্যা কবলিত এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।

কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী?

Advertisement

বন্যাদুর্গত এলাকাগুলিতে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ওই সব এলাকায় গুলিতে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া হয়। আমাদের ডাক্তারের অভাব রয়েছে। তবে জেলায় মাল্টি-সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, বাচ্চাদের ৩০০-৪০০ ইউনিট খুলেছি। ১০ হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আমরা এখানে নিয়োগ করেছি। ওই সব এলাকায় স্থানীয় ডাক্তারদের প্রতিদিন ঘণ্টা দুয়েক সময় দিতে বলেছি।’’

প্রশ্ন উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি নিয়েই। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে মোট ৩৪টি মাল্টি-সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়ার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত একটি হাসপাতালও পরিষেবা দেওয়া শুরু করেনি। তা হলে সেখানে বন্যাদুর্গতদের চিকিৎসা কী করে হচ্ছে? কী করেই বা সেখানে বাচ্চাদের ৩০০-৪০০ ইউনিট খোলা হল, সে প্রশ্নও উঠেছে। রাজ্যে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের পরিষেবায় নজরদারিতে গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাচ্চাদের এই বিশেষ ইউনিট সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘‘আমি এ রকম কোনও ইউনিটের কথা শুনিনি!’’ পরে মুখ্যমন্ত্রীর নবান্নের বক্তব্যের কথা জানানো হলে ত্রিদিববাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছেন, তখন নিশ্চয়ই হয়ে থাকবে। আমাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’’

এ দিন স্বাস্থ্য ছাড়াও রাজ্যের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হিসেব দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, বন্যায় মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রাজ্যের ১২টি জেলার সমস্ত মৌজা বন্যা কবলিত। সোমবার রাতেই দিল্লি পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দু’দিনের সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। কথা বলবেন একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গেও। বন্যাত্রাণ ও ছিটমহল নিয়ে কেন্দ্রীয় সাহায্যের জন্য দরবার করবেন। সূত্রের খবর, আগামী বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা মমতার। সেখানে বন্যাত্রাণ ও ছিটমহলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ছাড়াও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দিল্লির অনুদান বাড়ানোর দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাবেন মমতা। বন্যাত্রাণের জন্য বাড়তি অর্থ দাবি করা ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষিঋণ মকুবের প্রশ্নে কেন্দ্রও যাতে এগিয়ে আসে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করবেন মুখ্যমন্ত্রী।

এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই কিছুটা আশার আলো পাওয়া গিয়েছে কেন্দ্রের তরফে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ মমতাকে ফোন করে সব রকমের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, রাজ্য চাইছে এই বন্যাকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করুক দিল্লি। তাই এ বিষয়ে চলতি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্যসহকারে বন্যার ভয়াবহতা তুলে ধরবেন মমতা।

অবশ্য শুধু রাজ্যের জন্য ত্রাণের দাবিই নয়। জাতীয় রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কয়েকটি বিরোধী দলের সঙ্গেও চলতি সফরে কথা বলবেন মমতা। এই সফরে তাঁর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালেরও। চলতি সফরে মমতা উঠেছেন তাঁর ভাইপো তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে। তৃণমূল সূত্রের খবর, আগামীকাল সেখানে এসে মমতার সঙ্গে দেখা করতে পারেন কেজরীবাল।

চলতি বাদল অধিবেশনের গোড়া থেকেই নরম-গরম কৌশল নিয়ে চলছে তৃণমূল। সুষমা-বসুন্ধরা প্রসঙ্গে প্রায় সবক’টি বিরোধী দল এককাট্টা হয়ে পথে নামলেও সে পথে হাঁটেনি তৃণমূল। বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও কড়া অবস্থান না নিয়ে বরং সার্বিক দুর্নীতি নিয়ে সংসদের বাইরে প্রতীকী ধর্নায় বসেছেন দলের সাংসদরা। আবার কংগ্রেস সাংসদদের সাসপেন্ড করার প্রতিবাদে লোকসভা বয়কটও করেছেন তাঁরা। মমতা আগামী দু’দিন রাজ্যের নানা দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি বিজেপি বিরোধী কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসাটাও তাঁর কর্মসূচিতে রয়েছে। জেডিইউ, সপা-বসপার মতো আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্বের সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনাও সারবেন তৃণমূল নেত্রী।

ভারসাম্যের রাজনৈতিক কৌশল থাকলেও মমতা-ঘনিষ্ঠ শিবিরের দাবি, এ বারে রাজ্যের দাবি নিয়ে দরবারই মুখ্যমন্ত্রীর সফরের মূল থিম হতে চলেছে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য বাড়তি অর্থ চাইবেন মুখ্যমন্ত্রী। ছিটমহল হস্তান্তরের পরে বাসিন্দাদের পুনর্বাসনে রাজ্য যে অর্থ দাবি করেছিল, বাস্তবে যথেষ্ট লোক না আসায় তা পাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের দাবি, এর ফলে ছিটমহলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও পরিকাঠামোগত নির্মাণের কাজ ব্যাহত হবে। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি মতো অর্থই পাচ্ছে রাজ্যে। যে সংখ্যক লোক ভারতে আসছেন, ঠিক তত জনের ভিত্তিতেই কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করছে পশ্চিমবঙ্গের জন্য। বৈঠকে মোদী-মমতা উভয়পক্ষই তাদের যুক্তিগুলি তুলে ধরবেন।

মমতার তালিকায় রয়েছে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের সমস্যাও। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠক করার কথা তাঁর। সেই বৈঠক হবে কি না তা নিয়ে রাত পর্যন্ত সংশয় থাকলেও মমতা-শিবিরের দাবি, তাঁরা বৈঠকটি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে মমতার। বিশেষ করে রেলের প্রকল্পগুলি রূপায়নে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে সরব হবেন তিনি। মেট্রোর কাজে ঢিলেমি বা পূর্ব করিডরে ক্ষেত্রে তৎপরতার অভাব নিয়ে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে রয়েছে মমতার। কারণ, তিনি মনে করেন, পূর্ব করিডর বাস্তবায়িত হলে জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী সমস্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হবে।

রাজ্যের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ, ভূটান ও নেপালের সীমান্ত থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত এলাকার উন্নয়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্র যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করছে না। ওই ক্ষেত্রে বাড়তি বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে মমতার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement