দেড় বছরের ছেলের চোখে ছড়াচ্ছে ক্যানসার। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
দেড় বছরের একরত্তি ছেলেটার ডান চোখে ক্যানসার ছড়াচ্ছে দ্রুত। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে আগেই। এখন গোটা চোখটা দলাপাকানো মাংসপিণ্ড হয়ে গিয়েছে। যন্ত্রণায় ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না ঝাড়গ্রামের বেনাগেড়িয়ার বাসিন্দা দেবা নামাতা।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করে কেমোথেরাপি না দিলে দেবার সেরে ওঠার প্রক্রিয়া আরও জটিল হবে। অথচ, চিকিৎসা ভাল ভাবে শুরু করা দূর, গত আড়াই মাসে দশ বারের বেশি ঝাড়গ্রাম থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসে হন্যে হয়ে ঘুরেও দেবাকে ভর্তিটুকু করতে পারেননি বাবা-মা। চিকিৎসকেরা লিখে দিয়েছেন, অবিলম্বে শিশুটির কেমোথেরাপি দরকার। অথচ অভিযোগ, রেডিওথেরাপি বিভাগে গিয়ে শুনতে হয়েছে, ‘‘ডাক্তারবাবু আসেননি। তাই কেমো দেওয়া হবে না।’’
দিশাহারা, হতদরিদ্র বাবা-মা তাই উপায়ান্তর না দেখে ছেলের চিকিৎসার জন্য গত ২০ জুলাই খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। দেবার বাবা পেশায় রিকশাচালক রঞ্জিত নামাতা-র কথায়, ‘‘আড়াই মাস ধরে শুধু হাসপাতালের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ঘুরে বেরিয়েছি। টিউমার বোর্ডের চিকিৎসকরা ১৫ জুলাই কেমোথেরাপি বিভাগে রেফার করলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু না থাকায় কেমো দেওয়া হল না। এখন মুখ্যমন্ত্রীই ভরসা।”
আরও পড়ুন
বাস্তুমতে বদল! উপাচার্যের খরচ ৩৬ লাখ
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার চিকিৎসকদের মানবিক হতে বলেছেন। গুরুতর অসুস্থদের বাধ্যতামূলক ভাবে হাসপাতালে ভর্তি করার নির্দেশও দিয়েছেন। তা হলে দেড় বছরের ছোট্ট দেবার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কলেজ সেই নির্দেশ মানছে না কেন? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির জবাব, ‘‘আমি এই ঘটনাটির কথা কিছুই জানি না। খোঁজ নিতে হবে।’’ একই সঙ্গে তিনি মানছেন, ‘‘এত দেরি তো হওয়া উচিত নয়। এতে ক্যানসার আরও ছড়িয়ে যাবে।’’
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রেডিওথেরাপি-র প্রধান শ্যামল সরকার অবশ্য জানালেন, চোখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল সংলগ্ন ‘রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি’ (আরআইও) তে প্রথমে রোগীকে দেখা হয়। তারা রোগীকে মেডিক্যালের অঙ্কোলজি বা রেডিয়েশন অঙ্কোলজি বিভাগে পাঠায়। তারা আবার খতিয়ে দেখে প্রয়োজনমতো হাসপাতালের টিউমার বোর্ডে রেফার করে। ফের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এতে বেশ খানিকটা সময় বেরিয়ে যায়। তারপর টিউমার বোর্ড নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে রোগীকে ফের আরআইও-তে ‘রেফার’ করে। শিশু রোগী হলে আরআইও আবার শিশু বিভাগে পাঠায়। তারপর সেখানে ভর্তি করে তার কেমোথেরাপি চলে।
অর্থাৎ, চিকিৎসার প্রক্রিয়া অতি দীর্ঘ। আর সেই নিয়মের জাঁতাকলেই আটকে রয়েছে দেবার চিকিৎসা। রঞ্জিতবাবু জানালেন, মাস তিনেক আগে দেবার ডান চোখের মণির কাছে একটা ফুসকুড়ি হয়েছিল। ক্রমে সেটা বড় হয়ে ফুলে ওঠে। দেবাকে তখন ঝাড়গ্রামের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম ঘোষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনই ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর নাওয়া-খাওয়া ভুলে দেবাকে নিয়ে বার বার কলকাতায় ছুটে এসেছেন বাবা-মা। কিন্তু এ বিভাগ থেকে অন্য বিভাগ ছুটে বেরিয়েই সময় কেটেছে।
অভাবের সংসারে দেবার চিকিৎসা নিয়ে তাই আতান্তরে পড়েছেন রঞ্জিতবাবু ও তাঁর স্ত্রী কাজলদেবী। বেনাগেড়িয়ায় মাটির বাড়ির উঠোনে দেবাকে কোলে নিয়ে বসে ছলছল চোখে কাজলদেবী বলেন, “ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। দিন দিন ওর কষ্ট বাড়ছে। আমাদের মতো গরিবদের বোধহয় এটাই ভবিতব্য।’’