হুজুর সাহেবের মাজারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার হলদিবাড়িতে সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি স্বাক্ষর করলেন ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা। কিন্তু তার পুরো কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার হলদিবাড়িতে হুজুর সাহেবের মাঠে প্রশাসনিক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভারতে ৫১টি এবং বাংলাদেশের ভিতরে ১১১টি ছিটমহল হস্তান্তর হয়েছে ৩১ জুলাই রাতে। স্বাধীনতার পর থেকে সবাই বলেছিল হবে হবে। কিন্তু হয়নি। আমাদের মা-মাটি-মানুষের সরকার ক্ষমতায় এসে পরিবর্তনের কথা দিয়েছিলাম। কথা রেখেছি। এ পার বাংলার মানুষ ও পার বাংলার মানুষ আজ স্বাধীনতা পেয়ে গর্বিত, আনন্দিত।” এর পরেই তিনি দাবি করেন, “আমি বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। পরে ফিরে এসে ছিটমহলেও গিয়েছিলাম। তার পরেই হস্তান্তর হয়েছে।” তাঁর আরও দাবি, শুধু স্বাধীনতা নয়, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতেই তিনি হলদিবাড়িতে এসেছেন। তিনি বলেন, “৪২৪ কোটি টাকা দিয়ে দিলাম। মানুষের সেতুর স্বপ্ন পূরণ হবে।” পরে তিনি সাংবাদিক বৈঠকে জানান, ছিটমহলের উন্নয়নে প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। সেখানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে। যদিও বাস্তব হল, তাঁর এককাট্টা আপত্তিতেই আগের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ছিটমহল বিনিময় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেননি। বছর দেড়েক আগেও মুখ্যমন্ত্রী ছিটমহল বিনিময় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘রাজ্যের এক ইঞ্চি জমিও বাংলাদেশকে ছাড়ব না!’’
বৃহস্পতিবার ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘‘ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময়ের পরে আজ আমি কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি পরিদর্শন করলাম। আমি তিস্তা নদীর উপরে দীর্ঘতম সেতুর শিলান্যাস করেছি। এই সেতু হলদিবাড়ি ও মেখলিগঞ্জের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করবে, যা ওই এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়নে আমাদের প্রতিশ্রুতিরই অঙ্গ। আমি এই সেতুর নাম দিয়েছি ‘জয়ী’, যা দীর্ঘদিনের সীমান্ত-সমস্যা সমাধান ও ছিটমহলবাসীর দুর্দশা থেকে মুক্তি ও জয়ের প্রতীক হবে।’’
ছিটমহল সমস্যার সমাধান নিয়ে কৃতিত্ব পকেটে পুরতে বহু দিন থেকেই লড়াই শুরু হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য নয়াদিল্লি ও ঢাকা ঐকমত্যে পৌঁছনোর পর থেকেই তৃণমূল ও বিজেপি আসরে নামে। বামেরা অবশ্য বরাবরই ছিটমহল বিনিময়ের পক্ষেই সওয়াল করে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী গত বছরের ৪ ডিসেম্বর দিনহাটার করলা ছিটমহল সংলগ্ন এলাকায় সভা করেন। ছিটমহলের বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলেন। তার এক সপ্তাহের মাথায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলের পাশে সভা করে তৃণমূলের কৃতিত্ব খারিজ করে দেন। তৃণমূলের বাধায় এক সময়ে ছিটমহল বিনিময় যে আটকে গিয়েছিল, সে বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। সম্প্রতি কোচবিহার সফরে এসেও একই দাবি করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও মমতার কৃতিত্ব খারিজ করে বলেছিলেন, ‘‘ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া বহু দিন আগেই শুরু হয়েছে। মনমোহন সিংহ সরকার তো আগেই এ বিষয়ে সচেষ্ট হয়েছিল। মমতার আপত্তিতেই তা এত দিন আটকে ছিল।’’ যদিও বিজেপিও এর আগে বরাবর ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতাই করে এসেছে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে দলটি এ বিষয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করে।
ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ বলেন, “ছিটমহল সমস্যা সমাধানের বিষয়টি একান্তই কেন্দ্রের এক্তিয়ার। রাজ্যের নয়। দীর্ঘদিন ধরে ওই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্দোলন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হয়েছে। এখন কৃতিত্ব নিয়ে আকচাআকচি করার সময় নয়।” রাহুল সিংহের বক্তব্যের রেশ ধরেই বিজেপির কোচবিহার জেলার সাধারণ সম্পাদক নিখিলরঞ্জন দে দাবি করেন, ছিটমহল বিনিময়ের কৃতিত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধাতেই এত দিন তা আটকে ছিল। নিখিলবাবু বলেন, “ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং তাঁর উন্নয়নে টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকতেই হলদিবাড়ি-মেখলিগঞ্জ যোগাযোগের জন্য তিস্তায় সেতু নির্মাণ হচ্ছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী তা নিজের কৃতিত্ব বলে চালাতে চাইছেন।” ‘ভারত বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় সমিতি’র নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী সমহত হওয়াতেই ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। তাই তিনি কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। তবে সর্বভারতীয় স্তরে সমস্ত দল এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাই কৃতিত্ব সকলেরই।’’