Abhishek Banerjee Mamata Banerjee

আরজি কর-কাণ্ডে দলের বক্তব্যের অভিমুখ বাঁধলেন অভিষেক, সেই সুরে দিদির চিঠি মোদীকে, স্বস্তিপাঠ?

গত ১৫ অগস্ট থেকে অভিষেকের দফতর নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল সংবাদমাধ্যমে যোগাযোগের কাজ থেকে। তা দেখতে শুরু করে সুব্রত বক্সীর দফতর। আট দিন পর বৃহস্পতিবার মুখ খোলেন সেনাপতি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৪ ২১:৪৯
Share:

(বাঁ দিকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

একের পর এক ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্তে আরজি কর-পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে বসেছে, তখন কি বৃহস্পতিবার থেকে তৃণমূলের অন্দরে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ আবহসঙ্গীত বাজতে শুরু করল? নইলে সকালে দলের বক্তব্যের অভিমুখ বেঁধে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করার পরে বিকেলে সেই সুরেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? যা দেখে শাকক শিবিরের অন্দরে কিঞ্চিৎ আশা তৈরি হয়েছে যে, এ বার সেনাপতি ময়দানে নামার তোড়জোড় করছেন।

Advertisement

‘উৎসাহীরা’ এক ধাপ এগিয়ে এমন ধারনাও তৈরি করে ফেলেছেন যে, নিশ্চয়ই মমতা-অভিষেক একান্তে বৈঠক বা অন্ততপক্ষে ফোনে কথা হয়েছে। সেই কারণেই বৃহস্পতিবারের এই ‘তালমিল’। যা গত কয়েকদিনে একেবারেই ছিল না। অনেকের প্রশ্ন, তা হলে কি ওই সাম্প্রতিক ‘দূরত্ব’ বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল?

সূত্র দাবি করছে, মুখোমুখি বৈঠক তো নয়ই, ফোনেও দু’জনের কথা হয়নি। ফলে ‘বোঝাপড়া’র প্রশ্নও ওঠে না। অতএব, ঘটনাপ্রবাহ একেবারেই কাকতালীয়। অভিষেকের ঘনিষ্ঠমহল থেকে বলা হচ্ছে, তাঁর বক্তব্য ‘সামগ্রিক’ ভিত্তিতে করা। যেখানে তিনি কোনও অপরাধ এবং অন্যায়কে আড়াল করতে চাননি। সেগুলির পক্ষে কোনও যুক্তিও দিতে যাননি। তৃণমূলের এক নেতার দাবি, সকালে অভিষেকের ওই বক্তব্যের পরে বিকালে মমতার চিঠি ‘সমাপতন’।

Advertisement

তবে এক ‘আশ্চর্য সমাপতন’ বৈকি!

কারণ, অভিষেক আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে ধর্ষণের মতো অপরাধে দ্রুত এবং চরম শাস্তির পক্ষে আইন আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ‘চাপ’ তৈরির কথা বলেছিলেন। আর মমতা চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন সেই একই দাবিতে। বস্তুত, এক ধাপ এগিয়ে। বিচার এবং শাস্তিদানের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে।

আরজি কর আবহে তৃণমূল যখন ‘কোণঠাসা’, তখন সেনাপতি অভিষেকের ‘নীরবতা’ শাসকদলে নানা জল্পনা তৈরি করেছিল। আরজি কর ভাঙচুরের রাতে অভিষেক একটি ‘সময়ানুগ’ এবং পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি ‘আক্রমণাত্মক’ টুইট করেছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে তিনি সরেই ছিলেন। সূত্রের খবর, আরজি কর-কাণ্ডে প্রথম থেকেই বিবিধ ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়েছিল বলে অভিষেক মনে করেছেন। কিন্তু প্রশাসনে তাঁর বক্তব্যের কোনও অভিঘাত তৈরি হয়নি। তখন থেকেই তৃণমূলের সেনাপতি দূরত্ব তৈরি করেছেন। যাতে তাঁর লাভ বই ক্ষতি হয়নি। কারণ, প্রশাসন এবং তৃণমূলের গায়ে যে ‘কালিমা’ লেগেছে, তার দাগ অভিষেকের গায়ে লাগেনি। তবে পাশাপাশিই দলের অন্দরে অনেকে বলতে শুরু করেছিলেন, এই ‘সঙ্কটের সময়ে’ অভিষেকের দূরে সরে থাকাটা অনুচিত হচ্ছে। সর্বত্র ‘ভুল বার্তা’ যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সম্ভবত সেই কারণেই বৃহস্পতিবার অভিষেক মুখ খোলেন।

অভিষেক লেখেন, ‘গত ১০ দিনে যখন আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, মানুষ সুবিচারের দাবি জানাচ্ছেন, সেই সময়েও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ দিনে দেশে ৯০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রতি দিন ৯০টি ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট লেখানো হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি ঘণ্টায় চারটি এবং প্রতি ১৫ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অথচ এত কিছু সত্ত্বেও এই অপরাধের কোনও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বার করা গেল না।’ একই সঙ্গে অভিষেক দাবি করেন, কঠিন আইন চালু করার বিষয়ে রাজ্য সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ তৈরি করা।

বিকালে প্রধানমন্ত্রীকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে তিনি লিখেছেন, দেশে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোজ গড়ে ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে। এই ধরনের ‘গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর’ ঘটনা বন্ধ করতে অবিলম্বে কড়া আইন আনা প্রয়োজন। চিঠিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনার দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও রাখা হোক আইনে। ঘটনা ঘটার ১৫ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার দাবিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সকালে অভিষেকের পোস্টের পরে দলের নেতাদের বড় অংশ বলছিলেন, এই ‘ঝড়ঝঞ্ঝা’র সময়ে ‘পাল্টা আখ্যান’ বাতলে দিলেন। দলের অভিমুখ বাঁধতে চেয়েছেন সেনাপতি। সারা দেশের কথা উল্লেখ করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনা বাংলায় বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটছে তা নয়। এটা সার্বিক সমস্যা। দ্বিতীয়ত, আরজি কর নিয়ে মানুষের প্রতিবাদকে ‘স্বীকৃতি’ দিতে চেয়েছেন। তিন, এই প্রতিবাদকে ‘বাম-রামের’ বন্ধনীতে ফেলতে চাননি। চার, রাজ্য সরকারের কী ভূমিকা নেওয়া উচিত, সে ব্যাপারেও বার্তা দিয়েছেন। দুপুরে অভিষেক-ঘনিষ্ঠেরা ঘরোয়া আলোচনায় ‘সেনাপতি’র বক্তব্যের এমনই ‘নির্যাস’ বলতে শুরু করেছিলেন। যেমন একজন বলেছিলেন, ‘‘দাদা সরকারের কেউ না হয়েও বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধি হিসাবে বাংলার জন্য যা করা উচিত, সেই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়নের বিষয়ে রাজ্য সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘অভিষেকের স্পষ্ট কথা হল, রাজ্য সরকার এবং দলকে যখন এই পরিস্থিতির আঁচ পোহাতে হচ্ছে, তখন নবান্নেরই উচিত চলমান সিস্টেম বদলাতে উদ্যোগী হওয়া।’’

সরকারের বিভিন্ন কাজ নিয়ে যে অভিষেক ‘অসন্তুষ্ট’, তা লোকসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূলের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন। তাঁদের বক্তব্য, অভিষেক চান সরকার ও প্রশাসনকে গতিশীল করতে। নবান্ন যাতে ‘কাজ করলে থাকো, না হলে সরে যাও’ নীতি বলবৎ করে, সেটাই অভিষেকের ‘মূল চাহিদা’। অভিষেক মনে করেন, এখন থেকে এই নীতি চালু না করলে ২০২৬ সালের ভোটে দলকে পস্তাতে হবে। কারণ, ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে সংগঠন দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে না। যে আমলারা কাজের নন এবং শ্লথ, তাঁদের সরানোতে হবে। তাতে প্রশাসনের অন্দরে একটা ‘বার্তা’ দেওয়া যাবে। ‘ব্যর্থ’ মন্ত্রীদেরও সরানোর পক্ষে ছিলেন তিনি। কিন্তু তা না হওয়ায় তিনি ‘অসন্তুষ্ট’।

গত ১৫ অগস্ট থেকে অভিষেকের দফতর নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল সংবাদমাধ্যমে যোগাযোগের কাজ থেকে। তার পর তা দেখতে শুরু করেছিল সুব্রত বক্সীর দফতর। দলের লাইন কী হবে, কী বলতে হবে, বিভিন্ন চ্যানেলের বিতর্কে কারা যাবেন, সে সব ঠিক করার জন্য কুণাল ঘোষ, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, অরূপ বিশ্বাস এবং জয়প্রকাশ মজুমদারকে নিয়ে একটি ‘মিডিয়া টিম’ গড়ে দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু অভিষেকের দফতর যে পেশাদারিত্বের সঙ্গে ওই কাজ করত, তা গত সাত দিনে বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছে। যা তৃণমূলের মধ্যেও ‘উৎকণ্ঠা’ তৈরি করেছিল। তবে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি চলাকালীনই অভিষেকের দফতরের ‘সক্রিয়’ হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। যা তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের জন্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

গত বছর নভেম্বর থেকে এই নিয়ে তিনটি পর্বে অভিষেকের ‘সরে থাকা’ নিয়ে শাসকদলে আলোচনা চলেছে। আরজি কর পর্বে তা ‘অন্য মাত্রা’ পেয়েছিল। কারণ, ১৪-১৫ অগস্ট গভীর রাতে আরজি কর হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনার পর অভিষেক একটি পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে ফোন করে বলেছেন, দলমত না দেখে ব্যবস্থা নিতে। সেই সময়সীমা পার হওয়ার আগেই লালবাজার ধরপাকড় শুরু করে। কিন্তু তার পর থেকে অভিষেক ‘নিষ্পৃহ’ থেকেছেন। তাঁর দফতরও ‘নিষ্ক্রিয়’ থেকেছে। তাঁর অনুগামীরা ‘সেনাপতি পথ দেখাক’ পোস্টারে ছেয়ে দিয়েছেন সমাজমাধ্যম। কিন্তু অভিষেককে ‘সক্রিয়’ দেখা যায়নি। সেই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবারের সকাল-বিকাল তৃণমূলের জন্য ‘উল্লেখযোগ্য’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement