রাতে কোনও কারণে মুখ্যমন্ত্রী দরজা খুলে বেরিয়ে এলে, তিনি ওই আগন্তুকের সামনেও পড়ে যেতে পারতেন!
নিরাপত্তার ‘বজ্র আঁটুনি’ এড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যে আগন্তুকের ঢুকে পড়া নিয়ে রাজ্য তোলপাড়, জানা যাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে ছিল একটি লোহার রড! সেই রড নিয়েই ঘণ্টা সাতেক কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকার ঘরের উল্টো দিকে বসেছিলেন তিনি। তাই রাতে কোনও কারণে মুখ্যমন্ত্রী দরজা খুলে বেরিয়ে এলে, তিনি ওই আগন্তুকের সামনেও পড়ে যেতে পারতেন! সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত, তা ভেবেই শঙ্কিত অনেকে।মুখ্যমন্ত্রীর জ়েড প্লাস নিরাপত্তাকে কার্যত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে শনিবার গভীর রাতে তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়া ওই আগন্তুককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নাম হাফিজুল মোল্লা (৩১)। পুলিশের দাবি, প্রায় এক ফুট লম্বা লোহার রড জামার ভিতরে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কনফারেন্স হলের পিছনে ডান দিকে সাত ঘণ্টা চুপচাপ বসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ থানার নারায়ণপুর গ্রামের হাফিজুল। পুলিশ সূত্রে খবর, রবিবার সকালে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা কর্মীদের ‘শিফ্ট’ বদলের পরে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ টহলদারির সময়ে হাফিজুলকে বসে থাকতে দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে পুলিশকে দেখে পালানোর চেষ্টারও। তখনই তল্লাশির সময়ে জামার ভিতর থেকে লোহার রড বেরিয়ে আসে। যদিও কী কারণে তা সঙ্গে ছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।সাধারণত, মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি-র নিরাপত্তায় এত বড় ফাঁক দেখা দিলে, অবিলম্বে ডিউটিতে থাকা পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জবাবদিহি তলব করা হয় উচ্চপদস্থ অফিসারদেরও। কিন্তু অন্তত সোমবার রাত পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর, এমন ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাজনিত গাফিলতির কারণ কী, তার সঠিক উত্তরই সোমবার রাত পর্যন্ত সামনে আসেনি। পুলিশ শুধু ঘটনার বিবরণ দিয়ে এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির আশপাশের নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা দাবি করেছে। জানিয়েছে, অতিরিক্ত ১৮ জন কনস্টেবল মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের তরফে গাফিলতি ঠিক কোথায়, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। আগন্তুকের বাবার আবার দাবি, ‘‘ছেলের মাথা খারাপ।’’সূত্রের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে সোমবার বৈঠক করেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। সেখানে ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা, বিনীত গোয়েল এবং ডিরেক্টর-সিকিয়োরিটি বিবেক সহায়। পরে যোগ দেন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীও। সূত্রের দাবি, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের কর্তাদের নির্দেশ, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে তার পুনর্বিন্যাস করতে হবে। নিরাপত্তা নিয়ে কার কী গাফিলতি, তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ করতে হবে দ্রুত। সূত্রের খবর, এ দিন বৈঠকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বিবেককে। তবে এ নিয়ে নবান্নের কেউ মুখ খোলেননি। এই ঘটনার পরে এ দিন নবান্নের নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। যাচাই করা হয়েছে সিসি ক্যামেরাগুলি। পুলিশের একাংশের যদিও প্রশ্ন, এমন ধরনের ঘটনায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড করার উদাহরণ রয়েছে। সেখানে এখনও পর্যন্ত ভুল কার, তা চিহ্নিত করা গেল কোথায়!প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছে, রাত ১টা ২০মিনিট নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির পাঁচিল টপকে ঢুকেছিলেন হাফিজুল। তদন্তকারীদের একটি দল হাসনাবাদ পৌঁছে এলাকায় খোঁজখবর করছে বলেও লালবাজার সূত্রে খবর। হাফিজুলকে এ দিন আলিপুর আদালতের মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারকের এজলাসে তোলা হলে, বিচারক সাত দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি আইনজীবী সৌরীন ঘোষাল আদালতে বলেন, ‘‘কী উদ্দেশ্যে হাতে লোহার রড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে তিনি বাড়িতে ঢুকলেন, তা জানতে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জেরা করার প্রয়োজন রয়েছে।’’নারায়ণপুরে গ্রামের বাড়িতে বসে হাফিজুলের বাবা বলেন, ‘‘ছেলের মাথা খারাপ। রাত হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। আগে এক বার হাসনাবাদ থানার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। এক বার নবান্নে ঢুকে পড়ায় পুলিশ ধরেছিল। এ বার শুনছি দিদির বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।’’ ‘দিদি’কে ভালবাসেন বলেই ছেলে কখনও নবান্ন, কখনও বাড়িতে চলে যায় বলে বাবার দাবি। হাফিজুলের স্ত্রীর কথায়, ‘‘আগে ভালই ছিল। পাঁচ-সাত মাস হল মাথা খারাপ হয়েছে। কাউকে কখনও মারে, কখনও গলায় দড়ি দিতে যায়। গরম উনুনের মধ্যে হাত দিয়েছিল। আমরা গরিব। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই।’’ পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশের অভিযোগেই হাফিজুলের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেক্টর শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাট থানায় এফআইআর দায়ের করেছেন। যার ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৫৮ নম্বর ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। এক পুলিশকর্তার কথায়, কী উদ্দেশ্য নিয়ে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ভিতরে উনি ঢুকেছিলেন, তা জানা দরকার। কোনও নাশকতার জন্য ‘রেইকি’ করতে আসা কি না, তা জানা দরকার। ধৃতকে নিয়ে পুরো ঘটনার পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গিয়েছে। সঙ্গে আর কেউ ছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাক্তন পুলিশকর্তা পঙ্কজ দত্ত বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকে জ়েড প্লাস নিরাপত্তা পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিরাপত্তা দেখভালের জন্য এক জন ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) পদের অফিসার সবর্দা দায়িত্বে থাকেন। তাঁর অধীনে থাকেন একাধিক আইপিএস অফিসার। এ ছাড়া আছে স্পেশ্যাল সিকিয়োরিটি উইং। নাকের ডগায় রয়েছে কালীঘাট থানা। এই সমস্ত ভেদ করে এক জন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটাল, অথচ পুলিশ জানতেও পারল না, এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। কার গাফিলতিতে এমন হল, তা চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।’’প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের কথায়, ‘‘গাফিলতি না থাকলে, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। লালবাজারেরও উচিত কন্ট্রোল রুম থেকে গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখা। নিশ্চয়ই কোনও গাফিলতি ছিল। মুখ্যমন্ত্রী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকেন। তাই এই সব ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল পুলিশের।’’ সূত্রের খবর, গত বছর একদল চাকরীপ্রার্থী টালি নালা টপকে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করার পরে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র-সহ পুলিশকর্তারা ওই বাসভবনের নিরাপত্তা নিয়ে সিকিয়োরিটি অডিট করেন। দেখা যায়, বলরাম বসু ঘাট রোড এবং পটুয়া পাড়ার দিক থেকে অনেক অলিগলি আছে, যেখান দিয়ে নজরদারি এড়িয়ে প্রবেশ করা সম্ভব। ওই জায়গার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। প্রশ্ন উঠছে, তার পরেও এমনটা ঘটল কী ভাবে?