তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
তিনি নেত্রী। তিনিই মুখ। এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম! ২০২৬ সালের ভোট পর্যন্ত এর বাইরে যে কিছু হবে না, দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত মারফত সেই বার্তাই দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিক্ষিপ্ত ভাবে তৃণমূলের মধ্যে থেকে যে ভাবে ‘ভিন্ন স্বর’ উঠছিল, তা থামিয়ে দিলেন ‘দিদি’। বৈঠকের শেষে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের অন্যতম নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যে যে ঘোষণা করেছেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তৃণমূলের সংগঠনে মমতাই নিরঙ্কুশ। একমেবাদ্বিতীয়ম!
সোমবারের বৈঠকের পরে তৃণমূলের তরুণ নেতাদের অনেকেই কার্যত মানসিক ভাবে মুষড়ে পড়েছেন। পাশাপাশি দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, দলের অন্দরে প্রস্তাবিত রদবদলের ভবিষ্যৎ কী? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রস্তাব তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন, তা কি মানবেন দলনেত্রী?
তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, বৈঠক শুরুর আগে নেত্রী মমতা বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের ‘শপথ’ করান। যেখানে বলা হয়, বৈঠকের অন্দরের কোনও বক্তব্য যেন প্রকাশ্যে না যায়। তিনি এমনও বলেন যে, কে কোথায় কী করছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কী কথা বলছেন— সমস্ত খবরই তাঁর কাছে রয়েছে! তিনি যে কোনও ধরনের ‘দলবিরোধী’ কার্যকলাপ বরদাস্ত করবেন না, তা-ও বৈঠকের শুরুতেই স্পষ্ট করে দেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী।
মূলত তিনটি বার্তায় দলের উপর মমতার ‘নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ’ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক, জাতীয় কর্মসমিতিতে সংযোজনের তালিকা। দুই, সংবাদমাধ্যমের সমন্বয়ে অরূপ বিশ্বাসকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব দেওয়া এবং বিভিন্ন জনের কথা বলায় গণ্ডি টেনে দেওয়া। তিন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাকে ‘গৌণ’ করে দেওয়া। যা নিয়ে বৈঠক শেষ হওয়া ইস্তক শাসকদলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
নবীনদের সবাই প্রবীণ
চন্দ্রিমা ঘোষণা করেছেন, তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতিতে পাঁচ জনকে সংযোজন করা হয়েছে। তাঁরা হলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস ভুঁইঞা, মালা রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জাভেদ আহমেদ খান। দলের মধ্যে এই পাঁচ জনই মমতার ‘আস্থাভাজন’ এবং ‘অনুগত’ হিসাবে পরিচিত। এবং প্রত্যেকেই প্রবীণ। যাঁরা অভিষেক বর্ণিত বয়ঃসীমা পেরিয়ে গিয়েছেন। সম্প্রতি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যখন তৃণমূলের নেতারা প্রশ্ন তুলছিলেন, হুমায়ুন কবীরের মতো কেউ কেউ যখন অভিষেককে উপমুখ্যমন্ত্রী করে তাঁর হাতে পুলিশ দফতর দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছিলেন, তখন ময়দানে নেমেছিলেন কল্যাণ। শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদের বক্তব্য ছিল, পুলিশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রকারান্তরে মমতারই সমালোচনা করা হচ্ছে। কল্যাণ স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা মনে করছেন মমতাকে দিয়ে বাদ দিয়ে তৃণমূল, তাঁরা একটু সামনে এসে বলুন না!’’
জাভেদ খানের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও তৃণমূলে আলোচনা শুরু হয়েছে। সপ্তাহ দেড়েক আগে কসবার তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে খুনের চেষ্টা হয়েছিল। কসবার রাজনীতিতে সুশান্ত বরাবরই জাভেদের ‘বিরোধী’ বলে পরিচিত। সেই সুশান্ত ওই ঘটনার পরে যেমন মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে দেখা করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন, তেমনই ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেকের অফিসে গিয়েও দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন। তার পর জাভেদও প্রকাশ্যে কসবার কাউন্সিলরের কীর্তিকলাপ নিয়ে নানা মন্তব্য করেছিলেন। সেই তাঁকেই জাতীয় কর্মসমিতিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তও তৃণমূলের অন্দরে স্পষ্ট ‘বার্তা’ হিসাবে আলোচিত হচ্ছে।
যদিও তৃণমূলের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, কেন্দ্রের ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে দল নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়েছে। ওয়াকফের বিষয়ে জাভেদের ‘জ্ঞান’ রয়েছে বলে দাবি দলের অনেকের। তাঁদের বক্তব্য, সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই জাভেদকে জাতীয় কর্মসমিতিতে নেওয়া হয়েছে। এর পাল্টা যুক্তিও অবশ্য রয়েছে। যে যুক্তি বলছে, ওয়াকফ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন আরও সংখ্যালঘু নেতা দলে রয়েছেন। তাঁদের না নিয়ে জাভেদকে অন্তর্ভুক্ত করা ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’।
দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মালা রায়ের অন্তর্ভুক্তিও তৃণমূলের অন্দরে ‘বার্তা’ হিসাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। একে তো সকলের মতো মালাও প্রবীণ। তার উপর কয়েক মাস আগে তাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। স্বাভাবিক হাঁটাচলায় সমস্যা রয়েছে। অভিষেক বরাবরই মনে করেন, একটা বয়সের পরে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া উচিত। কারণ, শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়। জাতীয় কর্মসমিতির সংযোজিত তালিকা দেখে তৃণমূলের অন্দরে রব উঠেছে— সংগঠনে অভিষেকের বয়ঃসীমার তত্ত্ব খারিজ করে নিজের মতো করে সংগঠনের রাশ হাতে রাখলেন মমতা।
স্পিকার বিমানের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও অনেকে ‘বিতর্ক’ তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, স্পিকার পদের বৃত কেউ কী করে একটি দলের জাতীয় কর্মসমিতিতে স্থান পান? যার পাল্টা বলা হচ্ছে, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যখন লোকসভার স্পিকার ছিলেন, সেই সময় তিনি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন। যদিও স্পিকার হওয়ার পর তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির কোনও বৈঠকে যোগ দেননি। পাশাপাশিই, এমন উদাহরণও দেওয়া হচ্ছে যে, লোকসভার স্পিকার হওয়ার পরে বিজেপি সুমিত্রা মহাজনকে দলের পদে আর রাখেনি। আইনত স্পিকারের অবশ্য দলের কমিটির সদস্য হওয়ার কোনও বাধা নেই।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন
মিডিয়ায় ‘বিশ্বাস’
আরজি কর পর্বের শুরুর দিকেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতর। তার পর থেকে সেই কাজ পরিচালিত হচ্ছিল রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর দফতর থেকে। সেই সময় থেকেই রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অলিখিত ভাবে ওই দায়িত্ব পালন করছিলেন। সোমবারের বৈঠক থেকে সে বিষয়ে পাকাপাকি সাংগঠনিক বন্দোবস্তের কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। দলের মুখপাত্রদের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অরূপকে। তিনিই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কারা কী কথা বলবেন, সে বিষয়টি ঠিক করবেন।
মুখপাত্রদেরও গণ্ডি কেটে দিয়েছেন মমতা। যেমন বিধানসভা বা রাজ্য রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলবেন কেবল শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা, শশী পাঁজা, মলয় ঘটক, কুণাল ঘোষেরা। তাঁদের এক্তিয়ার ওই পর্যন্তই। আবার দিল্লির বিষয়ে বলবেন ডেরেক ও’ব্রায়েন, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, কীর্তি আজাদ, সুস্মিতা দেব, সাগরিকা ঘোষেরা। রাজ্যের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারবেন কেবল দু’জন— অমিত মিত্র এবং চন্দ্রিমা। আবার শিল্প নিয়ে বলার অধিকার শশী এবং পার্থ ভৌমিকের। উত্তরবঙ্গ নিয়ে কথা বলবেন গৌতম দেব, উদয়ন গুহ, প্রকাশ চিক বরাইক। চা-বাগান বিষয়ে কথা বলার অধিকার একা মলয়ের। ঝাড়গ্রাম এবং আদিবাসী বিষয়ে কথা বলবেন বিরবাহা হাঁসদা।
তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে। এক, তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা বা নেত্রী যে ভাবে ‘যথেচ্ছ’ মন্তব্য করছেন, মমতা তাতে লাগাম পরাতে চেয়েছেন। দুই, তিনি মুখপাত্রদের বক্তব্যের এলাকা এবং বিষয় নির্দিষ্ট করে দিলেন। তৃণমূলে কথিত আছে, মমতার দু’টি ‘ছায়ার’ এক জন ফিরহাদ হাকিম, অন্য জন অরূপ। আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবাদমাধ্যম এবং মুখপাত্রদের বিষয়টি দেখভাল করার ভার গেল এক ‘ছায়া’ অরূপের কাছে। গোটা তালিকায় দলে অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিতদের নাম নেই। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
অভিষেকের মাঠ দিল্লি
অভিষেক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সোমবারের বৈঠক শেষে চন্দ্রিমা যে তালিকা পড়েছেন, তাতে অভিষেকের নাম রয়েছে দিল্লির মুখপাত্রদের তালিকার এক নম্বরে। স্বাভাবিক ভাবেই দলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, অভিষেককে কি বাংলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল? যদিও চন্দ্রিমা বলেছেন, ‘‘উনি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। উনি সব বিষয় নিয়েই বলবেন।’’ চন্দ্রিমার জবাব তৃণমূলের অনেকেরই ‘হজম’ হয়নি। একান্ত আলোচনায় অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, ‘‘তা-ই যদি হবে, তা হলে দিল্লির মুখপাত্রদের তালিকায় অভিষেকের নাম বলার কারণ কী? দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের নাম কেন মুখপাত্রদের তালিকায় থাকবে?’’
তবে অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তাঁকে কখনওই ‘মুখপাত্রের দায়িত্ব’ দেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছে, সংসদে এবং জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে কী ভাবে দল পরিচালিত হবে, সেই বিষয়গুলি তিনি যাতে দেখেন এবং সাংসদদের সঙ্গে ‘সমন্বয়’ করেন। অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের এ-ও বক্তব্য যে, চন্দ্রিমা যে ভাবে সাংবাদিক বৈঠক করে বিষয়টি ঘোষণা করেছেন, তা থেকেই অভিষেকের দায়িত্ব এবং এক্তিয়ার সম্পর্কে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ তৈরি হয়েছে। চন্দ্রিমার বক্তব্যে তার অবকাশ রয়েছে বলেও অভিষেকের ঘনিষ্ঠমহলের বক্তব্য।
তবে নতুন যে জাতীয় কর্মসমিতি সোমবার ঘোষিত হয়েছে বা শৃঙ্খলারক্ষার জন্য সংসদীয় দল এবং সংগঠনে যে তিনটি কমিটি তৈরি হয়েছে, সেখানে অভিষেকের ‘আস্থাভাজন’ বলতে প্রায় কেউই নেই। একটা সময়ে যাঁরা অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও ক্যামাক স্ট্রিটের দূরত্ব বেড়েছে বলে তৃণমূলের অনেকে দাবি করছেন। প্রসঙ্গত, সোমবারের বৈঠকের আগে অতি সম্প্রতি অন্তত দু’জনের রাজ্য স্তরের নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা অভিষেকের ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত।