মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শেখ হাসিনা।—ছবি পিটিআই।
কখনও ‘আপনি’, কখনও ‘তুমি’ বলছেন দেখে শেখ হাসিনাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিনীত আবদারে বলে ফেললেন, ‘‘আমাকে আপনি বলবেন না। ইংরেজিতে তো শুধু ইউ। আমাদের বাংলায় আপনি, তুমি দু’টো শব্দই আছে। তুমিটা অনেক আপন। আমাকে তুমিই বলবেন।’’ হাসিনা মৃদু হেসে কাছে টেনে নিলেন মমতাকে।
গোলাপি বলে ভারত-বাংলাদেশের টেস্টের উদ্বোধনী দিনে ইডেন উদ্যানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানানোর পর থেকে গৃহকত্রীর মতোই সারা দিন আন্তরিক আপ্যায়ণে ব্যস্ত থাকলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ম্যাচ দেখতে আসা ক্রিকেটের তাবড় তারকা, অভ্যাগতদের সঙ্গে কথায়, আলাপে সকলের ‘দিদি’ হয়ে মধ্যমণিও থাকলেন তিনিই।
হাসিনা পৌঁছনোর বেশ খানিকক্ষণ আগেই শুক্রবার দুপুরে ইডেনে পৌঁছে গিয়েছিলেন মমতা। বি সি রায় ক্লাব হাউসের লাউঞ্জে বসেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। তার পরেই এসে পৌঁছন বিসিসিআই-এর সচিব জয় শাহ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর পুত্র। সৌরভ দু’জনের আলাপ করিয়ে দেওয়ার পরে ঘরোয়া মেজাজে হাসি, মজা, হাল্কা গল্পে বেশ কিছুক্ষণ কাটান মমতা-জয়। খুব সচেতন ভাবেই রাজনীতির কথা এড়িয়ে মমতা খোঁজ নেন অমিত শাহর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে। ইডেনে চলে আসেন সচিন তেন্ডুলকরও। লাউঞ্জে বেশ খানিকক্ষণ জয়, সচিনদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা, খোশগল্প চলে মমতার।
হাসিনা চলে এসেছেন শুনে বি সি রায় ক্লাবহাউসের গেটে চলে যান মমতা। পাশে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। হাসিনার সঙ্গে দেখা হতেই দু’জনে দু’জনকে বলছেন, ‘কেমন আছেন?’ এর পরে গেট পেরিয়ে ড্রেসিংরুমের মধ্য দিয়ে মাঠে ঢোকার পথে র্যাম্পে হঠাৎই পা পিছলে যায় হাসিনার। হুড়মুড়িয়ে সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চকিতে হাসিনাকে ধরে ফেলেন মমতা। পাশে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরাও সামলে নেন হাসিনাকে। বড় কোনও অঘটন ঘটেনি।
এর পরে মমতা-হাসিনা মাঠে ঢুকতেই শুরু হয় দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত। ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশেরই জাতীয় সঙ্গীতে মমতা গলা মেলালেন দেখে হাসিনা বলেন, ‘‘একই কবি।’’ মমতার প্রত্যুত্তর, ‘‘একই রবি।’’ কথা বলতে বলতেই এর পর হাসিনাকে নিয়ে মমতা চলে যান ক্লাব হাউসে নিজেদের নির্দিষ্ট আসনে। বাংলাদেশের একের পর এক উইকেট পড়ছে দেখে কিঞ্চিৎ বিমর্ষ লাগে হাসিনাকে।
মমতা ফিরে যান লাউঞ্জে। মমতা লাউঞ্জে রয়েছেন শুনে দেখা করতে আসেন ভারতের অতীত ক্রিকেট তারকা কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, সুনীল গাওস্কর, আরও অনেক ক্রিকেটার, অভ্যাগত। ‘দিদি’র খোঁজ করতে করতে মমতার পাশে সোফায় বসে আপ্লুত শ্রীকান্ত বলেন, ‘‘দিদিকে খুব শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি।’’
খেলা চলতে চলতেই মধ্যাহ্নভোজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। গাওস্কর, শ্রীকান্তের মতো তারকা, অভ্যাগতরা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না, নিজে গিয়ে বারবার তদারক করে আসেন মমতা। দ্রুত চলে যান হাসিনার কাছে। ‘বেলা হয়ে যাচ্ছে, এখন খেয়ে নিন’। হাসিনাকে নিয়ে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে আসেন মমতা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হাসিনা ও তাঁর সঙ্গীদের আপ্যায়ণ করেন মমতা।
মধ্যাহ্নভোজ শেষে বেলা তখন প্রায় আড়াইটে। মাঠ ছেড়ে হাসিনা রওনা দেন তাজ বেঙ্গলের পথে। মমতা নবান্নে। গৃহকত্রীর মতো অতিথিদের সামলাচ্ছেন দেখে হাসতেই হাসতেই হাসিনা বলে যান, ‘‘মমতা তো এক মুহূর্ত বসে থাকতে পারে না! সবসময় ছুটে বেড়াচ্ছে!’’ মমতাও সলজ্জ মাথা নাড়েন— ‘‘সব সময়ই মনে হয় কিছু কাজ করি। এক জায়গায় বসে থাকতে পারি না!’’
সন্ধ্যায় বৈঠকের জন্য তাজে চলে আসেন মমতা। হাসিনাকে বালুচরি স্বর্ণচরি শাড়ি, দু’টো শাল উপহার দেন মমতা। বৈঠক সেরে ফের দু’জনেই ইডেনে। হাসিনা মমতাকে বলেন, ‘‘চলো একসঙ্গে গাড়িতে যাই।’’ বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের প্রোটোকলের মধ্যে মমতা ঢুকতে চাননি। তাই হাসিনার সৌজন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে মমতার বিনীত অনুরোধ, ‘‘না আমি বরং আগে যাই। আপনি আপনার মতোই আসুন।’’