আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন এখানেই থেমে থাকছে না। রাজ্য জুড়ে কথায় কথায় অস্ত্রের ব্যবহার পুলিশের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বিশেষ অভিযানে বেআইনি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার পরেও কিন্তু অস্ত্রের প্রকাশ্য ব্যবহার থামেনি। তোলাবাজি লেগেই আছে।
ফাইল চিত্র।
সমস্যা আগেও ছিল। কিন্তু তৃতীয় দফায় রাজ্যে ক্ষমতার আসায় এক বছরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে একের পর এক ঘটনায় রাজ্য তোলপাড় হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, প্রকারান্তরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তা মেনে নিয়েছেন। ক’দিন আগেই তিনি স্বীকার করেছেন, নদিয়ায় নাবালিকার মৃত্যু ও রামপুহাটের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার জন্য সরকারের মুখ পুড়েছে। এ জন্য ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে পুলিশের একাংশকে। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কড়া বার্তা দিয়েছেন। আর ৫ মে, তাঁর তৃতীয় সরকারের প্রথম বর্ষ উদ্যাপনের দিনে সরকার চালাতে কোনও ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন মমতা। ভুল শুধরে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তাকে হাতিয়ার করে তৃণমূল শিবির বোঝানোর চেষ্টা করছে, সরকার চালানোর প্রশ্নে তাদের সদিচ্ছার কথা। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে সরকারের উপরে আস্থা রাখার কথা। কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর
বার্তা ‘কথার কথা’ হিসেবেই থেকে যাবে না তো?
আক্ষরিক ভাবে না হলেও রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে এমন ‘সদিচ্ছা’র কথা কি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে আগে শোনা যায়নি? বিরোধীরা বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি আদৌ কানে ঢোকে না তাঁর দলের নানা স্তরের নেতাদের। সে ভাবে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। সকলে বহাল তবিয়তেই থাকেন। আর তাঁদের চাপেই পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন থাকে বলেও অভিযোগ।
দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সিন্ডিকেটরাজ এবং বালি-পাথরের বেআইনি কারবার বরদাস্ত করা হবে না বলে সরকারে আসা ইস্তক মমতা কত বার যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তা মান্যতা পেল কই? বীরভূমের বগটুইয়ে হত্যালীলা তো সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরই চরম প্রকাশ। রাজ্যের নানা প্রান্তে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আরও অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে।
বগটুই-কাণ্ডের এক দিকে যেমন রয়েছে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তেমনই রয়েছে গরু-বালি-পাথর পাচারের বখরা নিয়ে খেয়োখেয়িও— এমন দাবি অনেকেরই। দু’মাস আগেই হুগলির খানাকুলের পলাশপাই গ্রাম সংলগ্ন মুণ্ডেশ্বরী নদী থেকে দলীয় নেতাদের দাঁড়িয়ে থেকে বালি তুলে পাচারের ভিডিয়ো তুলে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ও সদস্যেরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে বিহিত চেয়েছিলেন। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
হিংসার নানা রূপ থাকে। ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক হিংসা দেখতে এ রাজ্যের বাসিন্দারা অভ্যস্ত। গত বছর বিধানসভা ভোটের পরেও রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অনেকে ঘরছাড়াও ছিলেন। রাজনৈতিক হিংসার সংস্কৃতি জিইয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। তখন অবশ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারেই ছিল। শপথ গ্রহণের পরেই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে রাজনৈতিক রং না দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু ২৬ মার্চ, পুর নির্বাচনের আগের দিন হুগলির কোন্নগরে বেধড়ক মারধর করা হয় বিজেপি নেত্রী কৃষ্ণা ভট্টাচার্যকে। তাঁর প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা ছিল। অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও, আরও কয়েক জায়গায় বিরোধী প্রার্থীরা আক্রান্ত হন। পুরুলিয়ার ঝালদায় খুন হন কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু। পুলিশের দাবি, পারিবারিক বিবাদের জেরে খুন। যদিও তপনের স্ত্রী পূর্ণিমার দাবি, খুনের কারণ রাজনৈতিক। ফল প্রকাশের কয়েক দিন পরে পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তকে তাঁর বাড়ির কাছেই গুলি করে খুন করা হয়।
এই চাপানউতোরের মধ্যে তৃতীয় তৃণমূল সরকারে পুলিশের ভূমিকা এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে দু’টি ক্ষেত্রে। একটি বীরভূমের বগটুইয়ে হত্যালীলা, অন্যটি হাওড়ার আনিস-কাণ্ড। ছাত্রনেতা আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে পুলিশের বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ তুলেছেন তাঁর পরিবারের লোকজন। রাজ্য সরকার ‘সিট’ গঠন করে তদন্ত করেছে। তার রিপোর্ট জমা পড়েছে আদালতে। কিন্তু তাতেও পুলিশের উপরে আস্থা ফেরেনি আনিসের পরিবারের।
শুধু কি পুলিশ? পুলিশের ‘সাহায্যকারী’ সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজকর্মও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আনিস-কাণ্ড ছাড়াও গত নভেম্বরে একটি ভিডিয়ো-ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রবীন্দ্র সদন চত্বরে কলকাতা পুলিশের এক সিভিক ভলান্টিয়ার এক যুবকের বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে। যুবক যত বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, ততই জুটছে সিভিক ভলান্টিয়ারের মার। চড়-থাপ্পড়ের সঙ্গেই বুকে পিঠে লাথি! কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে বরখাস্ত করা হয়। এর পরেও কখনও চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনায় সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম জড়িয়েছে, কখনও সরাসরি রাস্তায় গাড়ি ধরে টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। যা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজেদের পুলিশ ভাবতে শুরু করার কারণেই কি এই পরিস্থিতি?
রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রশ্নের আর এক দিকে রয়েছে হঠাৎ বেড়ে ওঠা নারী নির্যাতন। বছরখানেক আগেও নারীদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কলকাতা দেশের মধ্যে এগিয়ে ছিল। কিন্তু রাজ্যের রাজধানীতেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গিয়েছে। রাজ্যে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোড়ন ফেলেছে নদিয়ার ঘটনা। এখানে রক্তক্ষরণে নাবালিকার মৃত্যু এবং দেহ চুপিচুপি পুড়িয়ে দেওয়া নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে। ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, তেমন ওই ঘটনাকে ঘিরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্য মন্তব্যেও অবাক হয়েছেন অনেকে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন এখানেই থেমে থাকছে না। রাজ্য জুড়ে কথায় কথায় অস্ত্রের ব্যবহার পুলিশের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বিশেষ অভিযানে বেআইনি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার পরেও কিন্তু অস্ত্রের প্রকাশ্য ব্যবহার থামেনি। তোলাবাজি লেগেই আছে।
শাসক দলের দাবি, পুলিশ যে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়, এমন নয়। ধরপাকড় চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে অস্ত্র উদ্ধারে জোর বেড়েছে। কলকাতার ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি হয়েছে। পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনই গতি বেড়েছে শহরের রাস্তায়। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থায় এ জিনিস সম্ভব হয়েছে বলে লালবাজারের দাবি।
তবু আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে পুলিশ প্রশাসনের উপরে মানুষের আস্থা কি ফিরছে? জনসংযোগ এবং শুদ্ধকরণ— জোড়া লক্ষ্যে দলের কর্মসূচি ঠিক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী বছর পঞ্চায়েত ভোট। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে তো? না কি গত পঞ্চায়েত ভোটের ছবিই ফের দেখতে হবে রাজ্যবাসীকে? প্রশ্ন থাকছেই। (শেষ)