মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প সফল করার জন্য ভাঙন রোধ এবং নদীগর্ভের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রকল্প নিয়ে শুক্রবার কলকাতায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানেই মমতা তাঁর এই অভিমত স্পষ্ট করেন।
মাতৃ-বিয়োগের কারণে মোদী বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন ভার্চুয়াল প্রথায়। তবে কেন্দ্রের একাধিক মন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং ঝাড়খণ্ডের তিন মুখ্যমন্ত্রী ও বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কেন্দ্রের একাধিক পদস্থ কর্তা। জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে উপস্থিত সকলকে জানান, তাঁদের সকলের বক্তব্য তিনি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখবেন। পরে রাতে মোদী টুইটে লেখেন, গঙ্গা পরিষদের এ দিনের বৈঠক ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পকে শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি করেছে। বৈঠকে পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ ও বর্জ্য শোধন ব্যবস্থাকে ছোট শহরগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এক দিকে গঙ্গার ভাঙন এবং পলি সংস্কার না হওয়া এই রাজ্যের পক্ষে বড় সমস্যা তৈরি করেছে বলে বারবার কেন্দ্রকে জানিয়েছে নবান্ন। রাজ্যের বক্তব্য, একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। চাই অর্থ এবং কেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশী বিহারের সঙ্গে সমন্বয়। এ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কার্যত অসম্ভব। এ নিয়ে একাধিক বার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে কেন্দ্রের পদস্থ কর্তারা গঙ্গা তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের খতিয়ান দেন। মমতা তখন বলেন, ক’টা আধুনিক শ্মশান তৈরি হল, কতগুলি ঘাট বাঁধানো হল, ক’টা সৌন্দর্যায়নের কাজ হল, শুধু তার হিসেব দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মালদহ থেকে ফরাক্কা, মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার গতিপথে ভাঙন যে ভাবে সমস্যা তৈরি করছে এবং রাজ্যকে তার আর্থিক দায়ভার যে ভাবে বইতে হচ্ছে, সেই বিষয়গুলি পর্যালোচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ কতৃপক্ষ ভাঙন রোধে ২০০৬-২০১৯ সালের মধ্যে ৩৪২ কোটি টাকা দিয়েছিল। রাজ্যের দাবি, সেই কাজের কোনও ‘ইতিবাচক’ প্রভাব দেখা যায়নি। উপরন্তু ৩১টি সমস্যাবহুল এলাকায় রাজ্য নিজের খরচে ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে ১৬৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। আরও ৮০ কোটি টাকার ভাঙন মোকাবিলার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। একটি সূত্র বলে, মমতা তাঁর বক্তৃতায় এগুলি সবই জানিয়েছেন এবং বলেছেন, বিহার বাংলা ও কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে সুসংহত পদক্ষেপ সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বিহার থেকে এ রাজ্যে ঢোকার পরে বাংলাদেশ পর্যন্ত গঙ্গার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রথম ১৫ কিলোমিটার যথেষ্ট সমস্যাবহুল। তার মধ্যেও ৬ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। রাজ্য সরকার স্যাটেলাইট সমীক্ষা করে দেখেছে, ওই এলাকায় ফুলাহারের সঙ্গে গঙ্গার দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৩ কিলোমিটার। এতে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, শমসেরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকা চরম ভাঙনের সঙ্কটে রয়েছে।
রাজ্য কেন্দ্রকে জানিয়েছে, ফরাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল গঙ্গার ৪০ হাজার কিউসেক জল ভাগীরথী-হুগলি নদী খাতে প্রবাহিত করার জন্য। কিন্তু বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় নদীগর্ভের সংস্কার না হওয়ার জন্য নাব্যতা কমছে এবং ভাঙন ও বন্যার প্রবণতা বাড়ছে। এতেই মালদহ-মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় সমস্যা বাড়ছে।
জানা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে এ দিন এই বিশদ ছবি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, বাংলা, বিহার এবং গঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মধ্যে সমন্বয় করে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা হোক, যাতে ‘ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বর্ডার সিকিউরিটি প্রোগ্রামে’ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে পারে।
এই প্রসঙ্গেই সুন্দরবনের জন্য সুসংহত মাস্টার প্ল্যান তৈরির কথাও উঠে আসে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। সুন্দরবন নিয়ে মোদীর কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছিল রাজ্য। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী এ দিনের বৈঠকে জানান, আমপানের পর থেকে রাজ্য নিজের খরচে সুন্দরবনে ১৫ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগিয়েছে। তার সঙ্গে ওই প্যাকেজ যুক্ত হলে কাজটি সুসংহত রূপ পেতে পারে।
প্রসঙ্গত, ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের কাছে বকেয়া টাকার কথাও এ দিন শুনিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, এখনও ৬৫০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অথচ সেই প্রকল্পে জব কার্ডধারীদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে গিয়ে রাজ্যকে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।