রাজনীতি মানেই পাশে দাঁড়ানোর খেলা। জ্বলজ্যান্ত বাস সেতুর রেলিং ফুঁড়ে বিলের জলে তলিয়ে গেল আর রাজনীতিকেরা ধারেকাছে থাকবেন না, তা কী করে হয়! পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতার ফাঁকেই তরজা বাধল শাসক ও বিরোধীর। মুখ্যমন্ত্রীও তীব্র আক্রমণ করলেন বিরোধীদের।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার সরকারি অনুষ্ঠান সেরেই হেলিকপ্টারে দৌলতাবাদ পৌঁছেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিছিয়ে না পড়ার তাগিদে সে দিন পড়িমড়ি দৌ়ড়েছিলেন কংগ্রেস বিধায়কেরাও। তবে বিরোধীদের সেই মরিয়া চেষ্টা রয়ে গিয়েছিল অন্তরালেই। কিন্তু ঘটনাস্থল ঘুরে এসে বিরোধী সাংসদ-বিধায়কেরা মুখ খুলতেই বুধবার তাঁদের এক হাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পাল্টা আক্রমণ করতে গিয়ে নাম না করেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নিশানা করেছেন বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক মনোজ চক্রবর্তীকে। দুর্ঘটনার দিন বহরমপুরের বিধায়ক মনোজবাবু ট্রেনে চেপে আসছিলেন কলকাতা। পথেই জেলা থেকে এক সতীর্থের ফোন পেয়ে জানতে পারেন, বালির ঘাটের সেতু থেকে একটা সরকারি বাস বিলের জলে পড়ে গিয়েছে। ট্রেনে বসেই নম্বর জোগাড় করে তিনি ফোন করেন বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সচিবকে। আর জেলা কংগ্রেস নেতাদের জানিয়ে দেন, তিনি বিধানসভার কাজে যাচ্ছেন। বাকিটা যেন জেলার নেতারাই সামলে নেন।
কিন্তু তত ক্ষণে দিল্লি থেকে তৎপর হয়ে উঠেছেন বহরমপুরের সাংসদ ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। দ্রুত উড়ান ধরার জন্য তৈরি হতে হতে তিনি মুর্শিদাবাদে ফোন করে জানতে পারেন, বহরমপুরের বিধায়ক মনোজ ট্রেনে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ যায়, ট্রেন থেকে নেমে ফিরে যেতে বল! জেলার সতীর্থের কাছ থেকে সেই নির্দেশ যখন মনোজবাবুর ফোনে আসে, এক্সপ্রেস ট্রেন তখন অবিরাম ছুটছে কলকাতার দিকে! উপায় না দেখে বিধানসভার সরকারি গাড়িকে শিয়ালদহ স্টেশনে তলব করে নেন মনোজবাবু। স্টেশনে নেমেই আবার গাড়ি ধরে দে ছুট! সঙ্গে আর এক বিধায়ক আবু তাহের। সন্ধ্যায় অধীর যখন ঘটনাস্থলে, পাশে মনোজবাবু!
কংগ্রেসের বিধায়কেরা যে গাড়ি ডাকিয়ে ফিরে গিয়েছেন, পরে জানতে পেরে আবার বিপাকে পড়েন সিপিএমের আনিসুর রহমান। তাঁর ডোমকল হয়েই আসছিল দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাস। তাঁকেও তো যেতেই হবে! গাড়ি তাঁর নেই, ট্রন ধরলে যেতে রাত। অগত্যা পরের দিন সকালে ট্রেনপথে তিনি দৌলতাবাদ। তখনও বিল থেকে লাশ উঠছে। দৌলতাবাদের লাগোয়া বহরমপুর ছাড়া আর এক বিধানসভা কেন্দ্র মুর্শিদাবাদের বিধায়ক শাওনি সিংহ রায় অবশ্য কলকাতামুখী হওয়ার ঝুঁকিই নেননি!
সরেজমিন সব দেখে মনোজবাবুরা প্রশ্ন তুলেছিলেন সরকারি গাফিলতি নিয়ে। উত্তীর্ণ মুক্তমঞ্চে এ দিন তৃণমূলের বর্ধিত কোর কমিটির সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা বলেছেন, ‘‘বিপদে আগে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াও, তা নয়! দু’ঘণ্টা দমকলকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোন হরিদাস, ক্রীতদাস এর জন্য দায়ী? আরও ১০টা লোক তো বাঁচতে পারতো। ডিএম, এসপি-কে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার পরে আবার চিৎকার করা হচ্ছে! সকাল থেকে কী না কী খেয়ে আসে!’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘দেহ মোড়ার পলিথিন, সাদা কাপড়টাও কিনে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে পাঁচ লক্ষ টাকা। কোনও প্রশংসা নেই, খালি কুটুস কুটুস করছে!’’
যা শুনে ক্ষুব্ধ মনোজবাবু পাল্টা বলেছেন, ‘‘পলিথিন, সাদা কাপড়, ময়না তদন্ত তো সরকারেরই দায়িত্ব! স্থানীয় মানুষ, পঞ্চায়েত প্রধান সবাই মিলে ১০-১১ জনকে বাঁচানো হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী বরং না গেলেও উদ্ধারের কাজ একই রকম হতো!’’ আর অধীরবাবু প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন, সরকারি উদ্ধার শুরুর আগে যে ‘অচেনা, অজানা, দুর্লভ মানুষেরা’ মরণাপন্ন কিছু যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হোক।