ছবি: ফেসবুক
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁর সাফল্যের অন্যতম ‘ট্যাগলাইন’ ছিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’। ঝুলি উপুড় করে রাজ্যের মহিলারা ভোট দিয়েছিলেন তাঁকে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগেও যে তিনি সেদিকেই হাঁটবেন, সোমবার তা একপ্রকার স্পষ্টই করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন করছেন এবং বিজেপি তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, তখন মমতা কলকাতার রাস্তায় ‘সংহতি মিছিল’ করছিলেন। সেই মিছিলের পরের সভা থেকে তিনি বিজেপিকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। তৃণমূল শিবির মনে করছে, লোকসভা ভোটে মমতা প্রচারের ‘সুর’ বাঁধা শুরু করলেন।
বস্তুত, মমতা সোমবার তাঁর বহুশ্রুত এবং সফল স্লোগান ‘খেলা হবে’ও উচ্চারণ করেছেন। পার্ক সার্কাসের সভায় বক্তৃতার শেষে মমতা বলেন, ‘‘খেলতে হবে।’’ সমবেত জনতা পাল্টা বলে, ‘‘খেলা হবে!’’ মমতা তখন বলেন, ‘‘খেলা হবে। জিততে হবে!’’ জনতা বলে, ‘‘জিততে হবে! জিততে হবে!’’ এই বাক্য বিনিময় থেকেই স্পষ্ট যে, মমতা ‘নির্বাচনী মোড’এ ঢুকেই পড়েছেন। সেই কারণেই তাঁর বিজেপিকে নতুন পথে আক্রমণ আরও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
মমতার রাজনৈতিক সাফল্যের অন্যতম দু’টি কারণ হিসাবে দুই ‘ম’-এর কথা বলা হয়। মহিলা এবং মুসলিম। রামমন্দিরের উদ্বোধনের দিন সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য মিছিল করে মমতা একদিকে যেমন মুসলিম সংখ্যালঘুদের বার্তা দিয়েছেন, তেমনই বিজেপিকে ‘নারীবিরোধী’ বলে আক্রমণ করে মহিলাদের কাছে নিজের ‘সঙ্কেত’ পৌঁছে দিয়েছেন।
মমতা সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের শাসক দল বিজেপি কি মহিলাদের অপছন্দ করে? রামমন্দিরে ‘রামলালা’র মূর্তিতে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’র কথা টেনে এনে মমতার প্রশ্ন, ‘‘সীতা ছাড়া কি রাম হয়? যদি তা-ই হবে, তবে কৌশল্যা কোথায় গেলেন? মা কৌশল্যাদেবী ছাড়া তো রামের জন্মই হত না!’’
রামকে ৫০০ বছর পর তাঁর ‘ঘরে’ অর্থাৎ ‘জন্মভূমি’ অযোধ্যায় ফেরানোর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেই ‘ঘরে’ রাম পুজিত হবেন পাঁচ বছরের শিশুরূপে। তাই মন্দিরে সীতা নেই। কিন্তু মমতার বক্তব্য, শিশু রামের পাশে তার মাকেও তো রাখা হয়নি! প্রধানমন্ত্রীও রামভূমিতে সীতার নাম নেননি। কোথাও শোনা যায়নি রামের মায়ের নামের জয়ধ্বনিও। রামকে এ ভাবে তাঁর জীবনসঙ্গিনী এবং জন্মদাত্রী নারীদের থেকে আলাদা করে দেওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি রামের বিরুদ্ধে নই। রাম-সীতাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তোমরা তো কই সীতার কথা বলো না! সীতার নামই নাও না! তোমরা কি নারীবিরোধী?’’
সম্প্রতি মমতা ঘনিষ্ঠমহলেও বিজেপি সম্পর্কে ওই অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিজেপি তাদের শাসনাধীন কোনও রাজ্যেই মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রাখেনি। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে উদাহরণ দিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজস্থানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে শিন্ডে জিতলেও তাঁকে আর মুখ্যমন্ত্রী করা হয়নি। স্মৃতি ইরানি এবং নির্মলা সীতারামণ ছাড়া বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কোনও মহিলা মন্ত্রী নেই। বাকি যাঁরা মহিলা মন্ত্রী আছেন, তাঁরা কেউই ‘ক্যাবিনেট মন্ত্রী’ নন। ঘনিষ্ঠদের মমতা এ-ও জানিয়েছিলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাস করানোর বহু আগে থেকে তিনি তৃণমূলের প্রার্থিতালিকায় ৩৩ শতাংশের অনেক বেশি মহিলাকে রাখা শুরু করেছিলেন। বস্তুত, গত বিধানসভা ভোটেও তৃণমূলের প্রার্থিতালিকায় ৪২ শতাংশ মহিলা প্রার্থী ছিলেন।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘু মসলমিদের ভোটের পাশাপাশি প্রচুর মহিলা ভোটও পেয়েছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রকল্প ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে সহায়তা করেছিল। রাজ্যের গ্রামীণ মহিলারা মনে করেছিলেন, ওই প্রকল্পের ফলে তাঁদের ‘আর্থিক ক্ষমতায়ন’ হচ্ছে। মমতা নিজেও ঠিক সেই কথাটই বলেছিলেন। ওই প্রকল্পের ‘সাফল্য’ এতটাই ছিল যে, মমতার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যপ্রদেশে ভোটের আগে তৎকালীন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান শুরু করেছিলেন ‘লা়ডলি বহেনা’ প্রকল্প। শিবরাজ যে সাম্প্রতিক বিধানসভা ভোটে মধ্যপ্রদেশে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’কে রুখে দিতে পেরেছিলেন, তার অন্যতম কারণ ওই প্রকল্প বলেই মনে করে বিজেপি।
সেই সূত্রেই মমতা রামের সঙ্গে সীতাকে টেনে এনে বিজেপিকে ‘নারীবিরোধী’ তকমা দিয়েছেন। সংহতি মিছিলের সভামঞ্চে তিনি বলেছেন, ‘‘১৪ বছর বনবাসে সীতাই রামের সঙ্গে ছিলেন। অথচ তাঁকে নিজেকে প্রমাণ করতে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল। আমরা নারীর মর্যাদা জানি। তাই নারীশক্তিকে দুর্গারূপে পুজো করি। মনে রাখবেন, রামও কিন্তু সেই দুর্গারই পুজো করেছিলেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে।’’