এক বছর আগে এই সমাবেশ ঘিরেই ধুন্ধুমার হয়েছিল কলকাতায়। শহিদ মিনার ময়দানে জায়গা না পেয়ে অধৈর্য জনতা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল পুলিশের সঙ্গে। ভাঙা হয়েছিল পুলিশের গাড়ি, আহত হয়েছিলেন জনাপাঁচেক আইপিএস অফিসার। এক বছর পরে আজ, বৃহস্পতিবার সেই শহিদ মিনার ময়দানে সেই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সমাবেশেই অতিথি হিসাবে হাজির থাকছেন স্বয়ং পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
পুলিশ পেটানোর অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা চলছে, তাদেরই সভায় পুলিশমন্ত্রীর উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত ঘিরে বিস্ময় এবং চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরে। সিপিএম, কংগ্রেস এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, কে কোন সমাবেশে যাবেন, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর রাজনৈতিক বিবেচনার ব্যাপার। কিন্তু এ রাজ্যে অহরহ পুলিশের উপরে আক্রমণ হয়, রোষের মুখে পড়ে পুলিশ কখনও মাথা বাঁচাতে টেবিলের নীচে বা ফাইলের আড়ালে আশ্রয় নেয়। হামলাকারীরা শাসক দলের স্নেহধন্য হলে আক্রান্ত হয়েও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পায় না! তার উপরে যাদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলা চলছে, তাদেরই অতিথি হয়ে পুলিশমন্ত্রী বক্তৃতা করতে গেলে কেমন বার্তা যায়— প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
উদ্যোক্তা সংগঠন জমিয়তের রাজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বুধবার শহিদ মিনার ময়দানে প্রস্তুতি দেখতে দেখতে গত বছরের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমি মঞ্চে ছিলাম। বাইরে কারা কোথায় গোলমাল করেছে, আমি জানতাম না। উদ্যোক্তা হিসাবে আমার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। কিন্তু মঞ্চ থেকেই আমি সে দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলাম।’’ মামলা যখন প্রত্যাহার হয়নি, সেই সময়ে তাঁদের সমাবেশে পুলিশমন্ত্রী কেন? সিদ্দিকুল্লার জবাব, ‘‘তার উত্তর পুলিশমন্ত্রীই দিতে পারবেন! কত সংগঠনই তো মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকে! সিদ্দিকুল্লা ডাকলেই দোষ?’’ কেন তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে আজ সমাবেশে অবশ্য প্রস্তাব পাশ করবেন সিদ্দিকুল্লারা।
জমিয়তের সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীর নিজেরই। তৃণমূলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউ এই প্রশ্নে মুখ খোলেননি। তবে দলের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, ‘‘ওই সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ করা। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও বার্তা দেওয়া। সামাজিক সংগঠন হিসাবে জমিয়তে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করেছে এবং মুখ্যমন্ত্রীও যেতে সম্মতি দিয়েছেন।’’ যদিও একান্ত আলোচনায় শাসক দলের বহু নেতাই মানছেন, আসলে সংখ্যালঘু ভোটের টানে পুলিশ-ধর্ম পিছনে চলে গিয়েছে!
প্রত্যাশিত ভাবেই সে দিনের আক্রান্ত পুলিশ-কর্তারা এখন পুলিশমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তাঁরা পারতপক্ষে এই প্রসঙ্গ এড়িয়েই যাচ্ছেন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকার যেমন ফোন ধরেননি, মেসেজেরও জবাব দেননি। আর যুগ্ম কমিশনার দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ব্যস্ত’ আছেন বলে কথা বলতে চাননি। ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা বা তৎকালীন ডিসি (সেন্ট্রাল), অধুনা হাওড়ার পুলিশ কমিশনার ডি পি সিংহ মন্তব্য করতেই চাননি।
শাসক দলের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বে’র আবহে সিদ্দিকুল্লারা অবশ্য এ বার পুলিশের কাজ সহজ করতে চাইছেন। জমিয়তের দাবি, লাখতিনেক মানুষ আসবেন শহিদ মিনারের সমাবেশে। দূরের জেলা থেকে এ দিন রাতেই শহরে লোক পৌঁছতে শুরু করেছে। পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বহু স্বেচ্ছাসেবক রাখা হচ্ছে। মৌখিক এবং লিখিত ভাবে জমিয়ত নেতৃত্ব সমর্থকদের বার্তা দিচ্ছেন, কেউ যেন পুলিশ বা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করেন। কোনও অন্যায় হলেই আইনমাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, এ কথাও ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। পরিচিত রেওয়াজ ভেঙে এ বার সমাবেশের মঞ্চ হয়েছে বাস টার্মিনাসের দিকে। যার ফলে ময়দান মার্কেটের দিকে ফুটপাথ থেকে দোকানপাট তুলে দিয়ে, বাস সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা তৈরি রাখা হচ্ছে।
পুলিশের উদ্বেগ বাড়িয়ে সিদ্দিকুল্লাদের সমাবেশ চলাকালীনই রাস্তা অবরোধে নামবে ‘মাদ্রাসা বাঁচাও কমিটি’। আবার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল আগামী বছর থেকেই চালু করার দাবি এবং নিয়োগের পরীক্ষায় দুর্নীতির প্রতিবাদে আজই আইন অমান্য করার জন্য কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করে ধর্মতলার দিকে এগোবে এসইউসি-র দুই সংগঠন ডিওয়াইও এবং ডিএসও। ডিওয়াইও-র রাজ্য সম্পাদক নিরঞ্জন নস্কর এ দিন বলেন, ‘‘পুলিশ এখনও আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা ঘোষিত পথেই মিছিল নিয়ে যাব।’’ তবে পুলিশ সূত্রের খবর, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার বা বৌবাজারের ফিয়ার্স লেনে কর্মসূচি শেষ করতে বলা হতে পারে ওই দুই সংগঠনকে।