মা, মাটি ও মানুষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে মূর্তি বর্ধমানের মাটিতীর্থ উৎসবে। শুক্রবার উদিত সিংহের তোলা ছবি।
লাগে টাকা, দেবে কেন্দ্র! আর ভিড় জোগাবেন সরকারি কর্মীরা!
এমন সরল ফর্মুলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার আয়োজন করছে রাজ্য সরকার। ৯ ফেব্রুয়ারি বর্ধমানে ‘মাটিতীর্থ কৃষিকথা উৎসব’-এর উদ্বোধন উপলক্ষে।
চাষিদের নতুন কৃষি প্রযুক্তি শেখাতে ‘এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ (এটিএমএ) তহবিল থেকে টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার। অল্প জল, অল্প সারে কী ভাবে চাষ করা যায়, তা প্রধানত এই প্রকল্পেই শেখানো হয়। কিন্তু চাষিদের প্রশিক্ষিত করার পথে না-হেঁটে ওই তহবিলের ৫ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা কার্যত নয়ছয় করে উৎসব করতে নেমেছে রাজ্য সরকার।
মুখ্যমন্ত্রীর দলীয় সভার মতো প্রশাসনিক জনসভা ভরানোর কাজও এত দিন মূলত করতেন শাসক দলের নেতারাই। শুধু সরকারি সুযোগ-সুবিধা যাঁরা পাবেন, তাঁদের আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করত প্রশাসন। কিন্তু বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে সাধনপুরে ‘মাটিতীর্থে’র উদ্বোধনে লোক আনার ভার পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির প্রশাসনিক কর্তাদের উপরেই। ঠিক হয়েছে, বারোটি জেলা থেকে লোক আনা হবে। কে কত বাস পাঠাবেন, জেলাশাসকেরা তার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন মহকুমা, ব্লক শাসকদের।
প্রশাসনিক কর্তারা বলছেন, নামে সরকারি অনুষ্ঠান হলেও আদতে যে তা মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় পরিণত হবে, সেটা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলাই যায়। তাঁদের বক্তব্য, এ হেন ‘জনসভা’ একে তো হচ্ছে কেন্দ্রের টাকা জলে দিয়ে। লোক আনতেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রশাসনিক পরিকাঠামো!
এর আগে পরপর দু’বছর পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লব (বিজিআরইআই) প্রকল্পের টাকায় মাটি উৎসব করেছিল রাজ্য। এর পর কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কারণ, মেলার আয়োজন করে ওই প্রকল্পের টাকা খরচ করার কথা নয়। কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এ বারও ‘মাটি উৎসব কৃষিকথা’-র জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা সবুজ বিপ্লব প্রকল্পের থেকে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সিএজি-র আপত্তি দর্শিয়ে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক তাতে বাধা দেন। অগত্যা প্রায় সব টাকাই নেওয়া হচ্ছে ‘এটিএমএ’ তহবিল থেকে।
গত ২৭ জানুয়ারি রাজ্যের কৃষিসচিব নির্দেশ জারি করে জানান, মাটিতীর্থ কৃষিকথার জন্য এটিএমএ তহবিল থেকে বর্ধমান বরাদ্দ করেছে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হাওড়া ও হুগলি, প্রতিটি জেলা ১০ লক্ষ টাকা করে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এটিএমএ-র নানা কার্যাবলির জন্য এই খরচ দেখানো হবে।
কৃষি দফতরের এক অধিকর্তার দাবি, “তিন দিনের উৎসবে কৃষির সব প্রকল্প এক জায়গায় এনে প্রদর্শনী করা হচ্ছে। নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।” কিন্তু বাইরের জেলা থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে কি? নাকি তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সভা সেরেই বাসে উঠবেন? উত্তরে ওই অধিকর্তা আমতা আমতা করে বলেন, “যাঁরা আগ্রহী তাঁরা থাকবেনই।”
এটিএমএ-র এক জেলা আধিকারিক অবশ্য খোলাখুলি বলছেন, “প্রশিক্ষণ স্রেফ লোক-দেখানো। এটিএমএ-র টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে।” আর বর্ধমানের এক কৃষিকর্তা বলেন, “এটিএমএ-র বিপুল টাকা এ ভাবে এক সঙ্গে খরচ আগে দেখিনি। উৎসব না-করে এই টাকা ছোট-ছোট ভাগে কৃষি যন্ত্রাংশে ভর্তুকি-সহ নানা কাজে ব্যবহার করলে ভাল হতো।”
আরও প্রশ্ন হল, গত ২৮ জানুয়ারি পানাগড়ে মাটি উৎসব হয়ে গিয়েছে। মাস না-ঘুরতেই আবার একটি মাটি উৎসব কেন? সরকারি কর্তাদের কাছেই তা বিশেষ পরিষ্কার নয়। অনেকের মতে, সারদা কেলেঙ্কারিতে নাজেহাল তৃণমূল ক্রমশই পায়ের তলার জমি হারাচ্ছে। এই ধরনের উৎসব সেই হারানো মাটি ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। তৃণমূলেরই অনেক নেতা বলছেন, সাম্প্রতিক অতীতে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিজেপির উত্থান হয়েছে। তাই গ্রামাঞ্চলের ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে উঠেপড়ে উৎসবে মেতেছে মমতার সরকার।
জানুয়ারির মাটি উৎসবের সঙ্গে এ বারের উৎসবের ফারাক বলতে গেলে কিছুই নেই। নানা সরকারি দফতরের কাজকর্মের প্রচারের স্টল, কৃষি, মাছ-চাষ, উদ্যানপালন-সহ নানা বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের স্টল, নানা প্রকল্পের সুবিধাদান, আলোচনাচক্র কর্মসূচি প্রায় একই। শুধু এই উৎসব আকারে বড়। বর্ধমান জেলা প্রশাসনের এক কর্তা ভেবেচিন্তে বলেন, “মাটি উৎসব গ্রামীণ মেলা, গ্রামবাংলাকে তুলে ধরার উৎসব। মাটিতীর্থ কৃষিকথা দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলাকে নিয়ে কৃষি-সংক্রান্ত অনুষ্ঠান। চাষিদের নানা যন্ত্রপাতি ও অনুদান দেওয়া হবে। হবে কৃষি নিয়ে চর্চাও।” কিন্তু প্রশাসনের যাবতীয় মাথাব্যথা উদ্বোধনের দিন মুখ্যমন্ত্রীর সভা নিয়েই।
ওই দিনের অনুষ্ঠানের জন্য কোন ব্লক থেকে কত লোক নিয়ে যেতে হবে, তা-ও ইতিমধ্যেই বৈঠক করে ঠিক করে ফেলেছে জোলা প্রশাসন। যেমন, বর্ধমান সদর ব্লক থেকে আট হাজার, কালনা, কাটোয়ার প্রতি ব্লক থেকে এক হাজার করে লোক আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বীরভূম থেকে মোট পাঁচ হাজার লোক নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। যাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে তাঁদের কৃষি, প্রাণিসম্পদ বিকাশ, মৎস্য বা কৃষি বিপণনের উপভোক্তা তালিকায় সামিল করতেও বলা হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে প্রতিটি ব্লক প্রশাসন ও কৃষি দফতরকে ব্লক পিছু চল্লিশ জন করে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার, হাওড়া থেকে পাঁচ হাজার ও নদিয়া থেকে অন্তত দু’হাজার লোক নিয়ে যেতে বলা হয়েছে বলে খবর।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক লিখিত নির্দেশ দিয়েছেন, মহেশতলা ও ঠাকুরপুকুর থেকে একটি এবং বাকি ১১টি ব্লক থেকে দু’টি করে, মোট ২৪টি বাস পাঠাতে হবে। তাদের সঙ্গে বাঙুর হাসপাতাল থেকে একটি মেডিক্যাল টিম পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। হাওড়ার কয়েকটি ব্লকে কথা বলে জানা গেল, বাস পেতে অসুবিধা হলে বিডিও-দের জেলা পরিবহণ দফতরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ব্লকের তরফে পঞ্চায়েত সমিতিকে চাষি জোগাড় করার ভার দেওয়া হয়েছে।
তবে সভা ভরানোর কাজটা দলীয় নেতাদের তুলনায় সরকারি কর্তাদের পক্ষে অনেক বেশি জটিল। কারণ, শুধু বাস আর টিফিনের ব্যবস্থা করলেই হবে না, কে কে যাচ্ছেন তার তালিকা তৈরি করতে হচ্ছে প্রতি ব্লকের কৃষি আধিকারিককে। সেই মাস্টাররোল যাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। বর্ধমানের এক কৃষি আধিকারিকের কথায়, “যাঁরাই আসবেন, খাতায়-কলমে তাঁরা সরকারি উপভোক্তা। বলা হবে, কৃষি-সহ নানা প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেবেন তাঁরা।” কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সেই হিসেব পাঠাতে হবে জেলা কৃষি দফতরকে। যদিও এ ভাবে হিসেব দিয়ে পার পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান রাজ্যের কৃষিকর্তারাই।
শুক্রবার ঝিঙ্গুটির সাই স্টেডিয়াম লাগোয়া মাঠে গিয়ে দেখা গেল, কোথাও ফোয়ারা তৈরি হচ্ছে, কোথাও ফুল-ফলের গাছ বসছে। তৈরি হচ্ছে স্থায়ী স্টল। কৃষির যন্ত্রপাতি নয়, চোখে পড়ল মানুষের মডেল। তার মধ্যে সাদা শাড়ি, হাওয়াই-চটি পায়ে অনেকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে এক নারী। চাষের কাজে আনত নন, সটান দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
(সহ-প্রতিবেদন: নুরুল আবসার, সুস্মিত হালদার, দয়াল সেনগুপ্ত, শুভাশিস সৈয়দ ও আনন্দ মণ্ডল)