বরাত বিবাদেই শ্যাম-সঙ্কট

জামুড়িয়া কাণ্ডে ছায়া ফেলেছে মলয়-দোলা দ্বন্দ্ব

দাবিদাওয়া নিয়ে মালিক-শ্রমিক মতবিরোধ নয়। কারখানায় চাকরির প্রশ্নে এলাকাবাসীর সঙ্গে টানাপড়েনও নয়। রেল সাইডিংয়ের দখলদারি ঘিরে শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়েই জামুড়িয়ার শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা এখন বন্ধ হওয়ার মুখে! শ্যাম গোষ্ঠীর কর্তা এবং স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার হয়েছে, বছর দুই আগে রেলওয়ে সাইডিংয়ের রাশ হাতে পাওয়ার জন্য দু’পক্ষে যে টক্কর শুরু হয়েছিল, বৃহস্পতিবারের ঘটনা তারই পরিণতি।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৬
Share:

অলোক দাসের হাত দিয়েই দোলাকে সংবর্ধনা। পাশে মলয় ঘটক। লোকসভা ভোটের আগে জামুড়িয়ার টাউন হলে। —ফাইল চিত্র

দাবিদাওয়া নিয়ে মালিক-শ্রমিক মতবিরোধ নয়। কারখানায় চাকরির প্রশ্নে এলাকাবাসীর সঙ্গে টানাপড়েনও নয়। রেল সাইডিংয়ের দখলদারি ঘিরে শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়েই জামুড়িয়ার শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা এখন বন্ধ হওয়ার মুখে!

Advertisement

শ্যাম গোষ্ঠীর কর্তা এবং স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার হয়েছে, বছর দুই আগে রেলওয়ে সাইডিংয়ের রাশ হাতে পাওয়ার জন্য দু’পক্ষে যে টক্কর শুরু হয়েছিল, বৃহস্পতিবারের ঘটনা তারই পরিণতি। অভিযোগ, মূলত এলাকার তৃণমূল মন্ত্রী মলয় ঘটক এবং আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে সদ্য পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনের গোষ্ঠীর বিবাদেরই ফসল বর্তমানের অচলাবস্থা। যে বিরোধের প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার হুমকিতে তাঁরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন কারখানার মালিকপক্ষ। ও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও তোলা দেওয়া হবে না।

সমস্যার সূত্রপাত কী ভাবে?

Advertisement

স্থানীয় রাজনীতিক ও শিল্প-সূত্রের খবর: জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানাটি চালু হয়েছিল ২০০৮-এ। কারখানার কাঁচামাল, অর্থাৎ কয়লা ও আকরিক লোহা নামানো শুরু হয় রানিগঞ্জ-জামুড়িয়ার মধ্যবর্তী তপসির রেলওয়ে সাইডিংয়ে। রেক থেকে মাল নামিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী কারখানায় পৌঁছনোর বরাত পান দুই ঠিকাদার মিনিস্টার ও চিন্ময় মণ্ডল। এলাকায় ওঁরা কয়লার কারবারি হিসেবে পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের যোগাযোগের কথাও খোলাখুলি জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।

ওঁদের হাতে যত দিন সাইডিংয়ে মাল খালাসের বরাত ছিল, তত দিন কারখানা চালাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। শ্যাম গোষ্ঠী জামুড়িয়ায় নিজস্ব রেলওয়ে সাইডিং করার সিদ্ধান্ত নিতেই গোলমালের শুরু। কী রকম?

সংস্থার এক কর্তা জানাচ্ছেন, জামুড়িয়ায় সাইডিংয়ের জমি নিতে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলা হয়। সকলেই বাজারদরে জমি দিয়ে দেন। কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে দেখা যায়, তপসির ঠিকাদারেরাই জামুড়িয়া সাইডিং-এলাকার মধ্যে দু’কাঠা জমি কিনে রেখেছে! ওরা শর্ত চাপায়, নতুন সাইডিংয়ে মাল খালাসের একচেটিয়া বরাত পেলে তবেই জমি বেচবে। শেষমেশ ২০১২-র নভেম্বরে সংস্থার কর্ণধার ব্রিজভূষণ অগ্রবাল খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে বিহিত চান। মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি দলের এক সর্বভারতীয় নেতাকে বিবাদ মেটানোর নির্দেশ দেন। “ওই নেতার হস্তক্ষেপেই পঞ্চাশ হাজার টাকার জমি ১৫ লক্ষে কিনে নেওয়া হয়। শুরু হয় সাইডিং তৈরি।” বলেন এক শ্যাম-কর্তা।

দু’মাস আগে তাঁরা নতুন সাইডিংয়ে মাল নামানো শুরু করেছেন। এবং তপসির সেই পুরনো ঠিকাদারদের বদলে মাল খালাসের বরাত দিয়েছেন পরাগ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক জনকে, রাজনৈতিক ভাবে যিনি তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেনের ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয় মানুষের দাবি। কারখানার শ্রমিকদের অনেকে বলছেন, বরাত-ব্যবসার ‘সমীকরণ’ এ ভাবে পাল্টে যাওয়ার পরেই সাইডিংয়ে অশান্তি মাথা

চাড়া দেয়।

এ প্রসঙ্গেই উঠে আসছে জামুড়িয়া ব্লক তৃণমূলের যুব নেতা অলোক দাসের নাম। যিনি কিনা মলয় ঘটক ও তাঁর ভাই অভিজিৎ ঘটকের ঘনিষ্ঠ বলে দোলা গোষ্ঠী-সূত্রের দাবি। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের মঞ্চে অবশ্য দোলা-মলয়-অলোককে একই ফ্রেমে দেখা গিয়েছে। তা অশান্তিতে অলোকের ভূমিকা কী ছিল?

এলাকাবাসী ও শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, অলোক হামেশা সাইডিংয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। কখনও স্থানীয়দের কাজ দেওয়া, কখনও বা যন্ত্রের পরিবর্তে হাতে-হাতে পণ্য খালাসের দাবিতে। শিল্পমহল এর মধ্যে হলদিয়ার এবিজি-কাণ্ডের ছায়াও দেখছে। এবিজি-র যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাল খালাসের দরুণ হলদিয়া বন্দরে শ্রমিকের সংখ্যা কমছিল, বাড়ছিল খালাসের পরিমাণ। কিন্তু তৃণমূল শ্রমিক ইউনিয়নের লাগাতার বাধায় এবিজি-কে শেষমেশ হলদিয়া ছেড়ে পাততাড়ি গোটাতে হয়।

জামুড়িয়ার ওই বরাত নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী এতটা সক্রিয় কেন?

শ্যাম গোষ্ঠী সূত্রের ব্যাখ্যা: জামুড়িয়া সাইডিংয়ে রোজ গড়ে ৪০ হাজার টন কয়লা ও আকরিক লোহা নামানো হয়। সংস্থার এক কর্তার কথায়, “টনপিছু অন্তত দশ টাকা মিললেও সাইডিংয়ের মাল খালাসে দৈনিক রোজগার নয় নয় করে চার লাখ টাকা! তাই কেউই এর দখল ছাড়তে চায় না।” চিন্ময়বাবু অবশ্য এ দিন বলেন, “শ্যাম গোষ্ঠীর থেকে আমি তিরিশ লাখ টাকা পাই। পাওনা না-মিটিয়ে আমাকে ওরা সরিয়ে দিয়েছে।” কোনও রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ার কথাও মানতে চাননি তিনি। অন্য দিকে পরাগবাবুর দাবি, “আমি ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসা করে খাই। মলয়দা কিন্তু আমাকে চেনেন। দোলাদি চেনেন না। কোনও রাজনীতির মধ্যে আমি নেই।”

ওঁরা মানতে না-চাইলেও সাইডিংয়ে বরাত-দখলের মরিয়া লড়াইয়ের জেরে যে বড় মাপের গোলমাল বাধতে চলেছে, ক’দিন আগেই তার আঁচ পেয়েছিলেন শ্যাম গোষ্ঠীর কর্তারা। ওঁরা জানাচ্ছেন, ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তাঁদের সংস্থার এক কর্তা এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কাছ থেকে ফোন পান। প্রায় হুমকির সুরে তাতে বলা হয়, ‘অলোক দাসের হাতে সাইডিংয়ের কাজ ছেড়ে দিন। ওঁর সঙ্গে অভিজিৎ ঘটকরা রয়েছে। কোনও ঝামেলা হবে না।’ সংস্থার দাবি, তারা হুমকিতে মাথা নোয়ায়নি। শ্যাম-কর্তাদের বক্তব্য: তপসি সাইডিংয়ে কয়লা ও আকরিক লোহা ব্যাপক হারে চুরি হচ্ছিল। জামুড়িয়ায় নতুন ঠিকাদার লাগানোর পরে চুরিও কমেছে। তাই মাল খালাসের বরাত বদলের পথে হাঁটা হয়নি।

এবং অভিযোগ, এর পরের দিনই অলোক দাসের নেতৃত্বে সাইডিংয়ে হামলা হয়। যার জেরে বন্ধ করে দেওয়া হয় কারখানার যাবতীয় কাজকর্ম। শুক্রবারও কাজ শুরু হয়নি। শ্যাম গোষ্ঠীর ভাইস প্রেসিডেন্ট রতনকুমার চক্রবর্তীর প্রশ্ন, “আমরা বছরে ৬০-৭০ লাখ টাকা এলাকার সামাজিক উন্নয়নে খরচ করি। হুমকি বা চাপের মুখে নতি স্বীকার করব কেন?” পাশাপাশি রতনবাবু এ দিন জানান, “কারখানার ৮০% কর্মী আশপাশের গ্রামের লোক। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছি। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকও আমাদের সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন।” অলোক প্রসঙ্গে রতনবাবুর দাবি, “ও যে নিয়মিত ওখানে যাওয়া-আসা করছে, লোকজন নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে, এটা প্রত্যেকে জানে। সকলে এ-ও জানে, কায়েমি স্বার্থের জন্য ও এই সব করছে। আমার বা অন্য অফিসারদের সামনে কিছু বলেনি। তবে আমরা অন্য সূত্রে জানতে পেরেছি, ও কিছু টাকা চায়।”

এ ব্যাপারটাও তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে এনেছিলেন বলে জানিয়েছেন শ্যাম-কর্তা। অন্য দিকে অলোক বৃহস্পতিবার টাকা চাওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, “আশপাশের গ্রামের মানুষ কাজের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এর বেশি কিছু হয়েছে বলে আমি জানি না।” এ দিন মন্ত্রী মলয়বাবুর গলাতেও একই সুর। “নতুন সাইডিংয়ে জমির সমস্যা আমিই মিটিয়ে দিয়েছিলাম। ওখানে স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ চাইছে। জানি না, এর মধ্যে টাকা চাওয়ার কথা উঠল কী ভাবে। সবই আনন্দবাজারের গল্প” মন্তব্য মলয়বাবুর। তাঁর ভাই অভিজিৎ ঘটক এ দিন কারখানা-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তোপ দেগে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, “কে ফোন করে কার নাম নিল, তাতে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?

শ্যাম গোষ্ঠীর কোনও কর্তা হুমকি ফোন পেয়ে থাকলে পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?” অভিজিৎবাবুর দাবি, “তপসিতে শ্রমিক-নির্ভর পদ্ধতিতে মাল খালাস হচ্ছিল। নতুন সাইডিংয়ে যন্ত্রে হচ্ছে। তাই কাজের দাবিতে গ্রামের লোক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তোলা আদায়ের অভিযোগ ফালতু।”

তবে তৃণমূলেরই অন্য মহলের তরফে টাকা চাওয়ার অভিযোগের কথা মেনে নেওয়া হচ্ছে। যাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ ব্যক্তি মাল খালাসের বরাত পাওয়ায় গোলমালের সূত্রপাত বলে মনে করা হচ্ছে, সেই দোলা সেন এ দিন বলেন, “তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী ও দল বিষয়টি দেখছে। এটা ট্রেড ইউনিয়নের সমস্যা নয়। তাই আমি কোনও কথা বলব না।” কিন্তু এটা কি সত্যি যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বরাত পাওয়ার জন্যই মলয়-গোষ্ঠী গোলমাল পাকাচ্ছে?

দোলাদেবীর জবাব, “এর মধ্যে দয়া করে মলয় ঘটক-দোলা সেন বিরোধ আনবেন না। এটুকুই বলব, এটা শ্রমিক সংগঠনের বিরোধ নয়। আমার কোনও ঘনিষ্ঠও এর মধ্যে নেই।”

পরিস্থিতির সুযোগ নিতে বিজেপি ইতিমধ্যে আসরে নেমে পড়েছে। আসানসোলের সদ্য নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়ের অভিযোগ, শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর পাওনা-গণ্ডার সমস্যার জন্যই এই ঘটনা। “শনিবারই আসানসোল যাব। কারখানার তিন হাজার শ্রমিকের স্বার্থে লড়াই চালিয়ে যাব” এ দিন ঘোষণা বাবুলের। আর পরিস্থিতি দেখে-শুনে শ্যাম গোষ্ঠীর এক কর্তার মন্তব্য, “দু’-এক জন এমন আছে, যারা সত্যিই উন্নয়ন চায় না। তারা এ রকম করলে দলেরই ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এটা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আমরা চিঠি লিখেছিলাম। চাইছিলাম, এমন ঘটনা যেন অন্য জায়গাতেও না ঘটে।”

এই অবস্থায় জামুড়িয়ার কারখানা কি তাঁরা শেষমেশ বন্ধ করে দেবেন?

ওই কর্তার জবাব, “আমরা নিজেদের ভরসাতেই ওখানে কারখানা চালাচ্ছি। কিন্তু কেউ এ সব করলে মেনে নিতে পারি না। কোনও ইন্ডাস্ট্রিই মেনে নেবে না। এ ভাবে চলতে পারে না। আমরা রাজ্যের উন্নয়ন চাই। উন্নয়নের জন্য যতটা ধৈর্য রাখতে হবে, রাখব।” শ্যাম গোষ্ঠী গত সপ্তাহেই ঘোষণা করেছিল, তারা আগামী দু’বছরে রাজ্যে দু’হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। “এ ভাবে বাধার সৃষ্টি হলে তা কী ভাবে সম্ভব?” প্রশ্ন তুলেছেন কর্তাটি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement