মদন মিত্র। —ফাইল চিত্র ।
শুরু করেছিলেন কুণাল ঘোষ, সুর চড়িয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। এ বার আরও এগিয়ে আর জি কর হাসপাতালের নিহত তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা টাকা চান কি না, সেই প্রশ্ন তুললেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক মদন মিত্র! বাবা-মা ভোটে দাঁড়ানোর জন্য আসনের খোঁজ করতে পারেন তবে জিততে পারবেন না, এমন কথাও বলেছেন কামারহাটির বিধায়ক। যার জবাবে নির্যাতিতার বাবা প্রশ্ন তুলেছেন, টাকা দিলে তাঁদের মেয়েকে কি শাসক দলের নেতারা ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘লজ্জা রাখার জায়গা নেই! বাংলার মানুষ কবে ঘুম থেকে জাগবেন, তার অপেক্ষায় আছে নির্যাতিতা ডাক্তার-বোনের আত্মা।’’
মদনই শুধু নন, আর জি করের নির্যাতিতার বাবা-মায়ের প্রতি আক্রমণের ধুয়ো তুলে গলা মিলিয়েছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, সৌগত রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো শাসক দলের একাধিক নেতা-সাংসদ। নিন্দায় পাল্টা সরব হয়েছে বিরোধীরাও।
বাম-বিজেপির কথায় নির্যাতিতার পরিবার বারবার চিত্রনাট্য বদল করছে বলে অভিযোগ করে মদন বলেছেন, ‘‘পরিষ্কার ভাবে বলুন, সিপিএম এবং বিজেপি আমাকে যেটা বলছে, সেটা বলছি। তার জন্য আপনি কী চান? শুনেছি ডাক্তারদের চার-পাঁচ কোটি উঠেছিল। হ্যাঁ, যদি মনে করেন টাকা চান, টাকাই চান। সব কিছু টাকা দিয়ে ঢাকা যায়!’’ মদনের আরও বক্তব্য, ‘‘আমরা পড়েছি, শ্রাদ্ধে কিছু দিতে পারি না, টাকা দিয়ে বলে ওম নমো ওম নমো ব্রাহ্মণায়ো অহং দদানি। ছেড়ে দিল টাকা দিয়ে।’’
নিহত চিকিৎসকের বাবা-মা নির্যাতিতার পরিবার থেকে অন্যায়ের মদতকারীতে পরিণত হয়েছে বলেও আক্রমণ করেছেন মদন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এত দিন আপনারা প্রত্যেক সন্তানের কাছে মা-বাবা ছিলেন। এখন অন্যায়ে মদতকারী এবং বাস্তবমূল্যের কিছু দাবি জানানোর জন্য, নিজেদের উপকৃত করতে, ক্ষতিপূরণের জন্য চিত্রনাট্য বদলে দিতে চাইছেন।’’ আর জি কর-কাণ্ডের দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। সেই প্রেক্ষিতে তৃণমূল বিধায়কের পাল্টা তোপ, ‘‘বিচারক রায় দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেননি। বরং, নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে মমতা ফাঁসির আবেদন করেছেন। সেটা কেঁচিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাদের বিকাশবাবু (আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য), যিনি এক জন প্রমাণিত, নির্ভুল মিথ্যেবাদী, আপনাদের মুখে মিথ্যে বসিয়ে দিচ্ছে! বিজেপি-র কথা, সিপিএমের কথা। তা হলে আপনারা বলুন রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন। অনেক আসন ফাঁকা আছে। দাঁড়িয়ে যান! তাতে অনেকটা ক্ষতিপূরণ হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আপনারা মা-বাবা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন আদালতের কাছে। ফাঁসি না-চাইলে সিবিআই-কে বারণ করলেন না কেন? আর যদি ফাঁসি আর ফাঁসি নয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকতে চান, তা হলে কোথায় উপনির্বাচন আছে, খোঁজ করুন! তবে জিততে পারবেন না। চান্স নেই!’’
শাসক দলের নেতার এ হেন আক্রমণের মুখেও অবিচল থেকেছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। নিহত চিকিৎসকের বাবার বক্তব্য, ‘‘আবার বলছি, কোনও চক্রান্তে আমরা পা দিইনি। উনি (মদন) এসে দেখে যান, আমরা কী ভাবে আছি। আর টাকার কথা বলছি? তা হলে বলুন, কত টাকা দিলে আমাদের মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’’
মদনের পাশাপাশি রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী শোভনদেব বলেছেন, “ওঁরা নিজেদের মত বলছেন বলে মনে হয় না। সিপিএমের মত বলছেন। সিপিএম নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বাবা-মা’কে ব্যবহার করছে। বাবা-মা সিপিএমের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন।” তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগতের বক্তব্য, “ওঁদের বক্তব্যে গুরুত্ব দিতে চাই না। ওঁদের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, মেয়ে মারা গিয়েছেন। কিন্তু ওঁরা তো ঠিক করবেন না মুখ্যমন্ত্রী কে থাকবেন আর কে থাকবেন না। ওঁদের কথা আমরা অবহেলা করছি!” থামেননি তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণালও। তিনি ফের বলেছেন, “বাবা-মায়ের প্রতি পূর্ণ সম্মান, সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু তাঁরা নানা সময়ে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করবেন আর যাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে কুৎসা করছেন, তাঁদের হাত থেকে তামাক খাবেন, এটা হতে পারে না।’’
এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর বক্তব্য, ‘‘যে বাবা-মা মেয়েকে হারিয়ে বিচারের জন্য লড়াই করছেন, ক্ষতিপূরণ ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কুৎসিত আক্রমণে শামিল হচ্ছেন শোভনদেবের মতো নেতাও! লজ্জা রাখার সত্যিই কোনও জায়গা নেই।’’ বিরোধী নেতার আরও সংযোজন, ‘‘আমাদের হাতে যদি পুলিশ থাকতো, এই সব লোকজনের (মদন) জায়গা জেলে থাকতো!’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘জানি না এই কথা বলার সময়ে ওঁর (মদন) পিয়ালীর কথা মনে পড়েছিল কি না? টাকা দিয়ে কী ভাবে মুখ বন্ধ করা যায়, মদনেরা সে সব ভালই জানেন। প্রথমে আর জি করের চিকিৎসককে খুন করা হল, এ বার তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এক জন অভিযুক্তকে দ্রুত মেরে ফেলার দাবিতে শাসক দল আসরে নেমে বাবা-মা’কে জঘন্য আক্রমণ করছে।’’ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরীর মতে, ‘‘এঁরা জনপ্রতিনিধি? দুর্নীতি এবং অপরাধে মদতকারী এক জন মুখ্যমন্ত্রীর স্বার্থরক্ষা করতে জনপ্রতিনিধিরা যা করছেন, ভাবা যায় না!’’
বিধায়ক মদন সিপিএমের যে আইনজীবী-নেতাকে আক্রমণ করেছেন, সেই বিকাশও কটাক্ষ করেছেন, ‘‘ওঁরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন, তাতে সভ্য-ভদ্র আচরণ আশা করা যায় না। ওঁদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হল গুন্ডামি, দুর্নীতি।’’