হাসপাতালের শয্যায়। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র
এ অন্য মদন।
পুজোর ঠিক আগে, তখন পরপর তাঁর দুই ছায়াসঙ্গীকে ডেকে পাঠিয়ে টানা জেরা করছে সিবিআই। খোদ পরিবহণমন্ত্রীকেও তলবের বিলক্ষণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। মদন মিত্র সে সময়ে হঠাত্ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তারেরা বলেছিলেন, ‘প্যানিক-অ্যাটাক’। দীর্ঘদিন ধরে নানা আশঙ্কায় কাবু হয়েই মন্ত্রীর মধ্যে কিছু কিছু শারীরিক অসুস্থতার উপসর্গ দেখা গিয়েছিল।
এ মদন কিন্তু সে মদন নন! এ বার যখন মদনবাবুর কাছে সিবিআই জেরার তলব এল, তার আগে থেকেই তিনি পিঠের টিউমারের অস্ত্রোপচার করাতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। মঙ্গলবার রাতে সিবিআই জেরার বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। বুধবার কিন্তু অসুস্থ মন্ত্রী দিব্যি বুক বাজিয়ে জানিয়ে দিলেন, সিবিআই-টিবিআই সব কিছুর জন্য তিনি প্রস্তুত।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মদন ফুরফুরে মেজাজেই জানিয়ে দিয়েছেন, “আমি যে কোনও তদন্তের মুখোমুখি হতে তৈরি। চাইলে সিবিআই হাসপাতালে এসেই আমায় জেরা করুক।”
হল কী মন্ত্রীর? কোন ম্যাজিকে এতটা আত্মবিশ্বাসে বুক ভরে নিলেন তিনি?
দলীয় সূত্রের খবর, সিবিআই জেরার খাঁড়ার মুখে মদনকে চাঙ্গা করতে হাত রয়েছে স্বয়ং দলনেত্রীর। দিল্লি থেকে আসা মুখ্যমন্ত্রীর ফোনেই অক্সিজেন পেয়েছেন রোগশয্যায় শুয়ে থাকা পরিবহণমন্ত্রী। এ দিন সকালেই ফোন করে সিবিআইয়ের তলব এবং মদনের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর নেন মমতা। পাশে থাকার
আশ্বাসও দেন। মদন-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “ফোনে দিদি বলেছেন, এ সব চক্রান্ত। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রাজনৈতিক ভাবে আমরা এর মোকাবিলা করব। দাদা তার পর থেকেই অন্য মুডে।”
মাস দুয়েক আগে সিবিআইয়ের নিশানা মদনের দিকে প্রথম বার তাক করার আবহে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া এ রকম ছিল না। সে-বার নিউ টাউনে বাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী পরিবহণমন্ত্রীকে দেখেও দেখেননি। তাঁকে এড়িয়ে কোনও মতে পরিবহণসচিবের সঙ্গে দু’কথা সেরেই চলে যান মমতা। এমনকী বহু মন্ত্রী, বিশিষ্ট জনকে দেখতে হাসপাতালে গেলেও মদন হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ে ওই তল্লাটের সংস্রব এড়িয়ে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেই প্রেক্ষিতে এ বার রোগশয্যায় দিল্লি থেকে মমতার ফোনই মদনের কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। তৃণমূলে মদনের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর বরাভয় পেয়েই তিনি খোশমেজাজে। এক নেতার বক্তব্য, “রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকেও সিবিআই সাক্ষী হিসেবে ডেকে পাঠিয়েছে। একই চিঠি এসেছে মদনদার কাছে। তাই এ নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই বলেই মনে করছেন তিনি।” সিবিআইয়ের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করে মদনও অকুতোভয় ভঙ্গিতে বলেছেন, “ওদের তদন্তে সব রকম সহযোগিতা আমি করব।” শুধু সংবাদমাধ্যমের সামনে এ-সব ঘোষণাই নয়, সিবিআই-কেও তাঁর মনোভাব জানিয়ে দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। সিবিআই সূত্রের দাবি, গত রবিবারই মদনকে ফোন করে আগামী শুক্রবার দফতরে আসতে বলা হয়েছিল। মদন-শিবিরের অবশ্য দাবি, মঙ্গলবার ই-মেলে সিবিআই তাঁকে তলব করেছে। তার পর ওই রাতেই আইনজীবীদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন মদন। সিবিআই-কে কী জানানো হবে, তার বয়ান ঠিক হয় এ দিন। সেইমতো মদনের আইনি চিঠি এবং হাসপাতালের চিকিত্সা-ক্রমের যাবতীয় নথি পাঠানো হয়েছে সিবিআইয়ের সিজিও কমপ্লেক্সের দফতরে। তবে জানানো হয়েছে, অসুস্থতার কারণেই শুক্রবার তিনি সিবিআই দফতরে যেতে পারছেন না। সুস্থ হলেই দফতরে গিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে মন্ত্রী প্রস্তুত।
কিন্তু মন্ত্রীকে কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে, তা পরিষ্কার নয়। গত রবিবার থেকে মদন হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর পিঠের টিউমারটি শিরদাঁড়ার সঙ্গে যুক্ত কি না বুঝতে এমআরআই করা হয়েছে। একই সঙ্গে হয়েছে ইকোকার্ডিওগ্রাফি, এক্স-রে, ইসিজি এবং কিছু রুটিন রক্তপরীক্ষা। জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ফুসফুস বিশেষজ্ঞ, হৃদ্রোগ, স্নায়ু এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা দফায়-দফায় তাঁকে পরীক্ষা করে যাচ্ছেন। প্রাথমিক ভাবে এমআরআই রিপোর্ট দেখে অবশ্য টিউমারটি তেমন মারাত্মক নয় বলেই অভিমত চিকিত্সকদের। তবে বিশদে আরও কিছু পরীক্ষার পরেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শল্যচিকিত্সক দীপ্তেন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, মদনবাবু দিনে ১৫-১৬টি ওষুধ খান। তাঁর ডায়াবেটিস, ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুর সমস্যা এবং অবসাদের সমস্যা রয়েছে। তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খান এবং ঘুমের মধ্যে তাঁর শ্বাস আটকে যায় বলে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘুমোতে যান। এই সব সমস্যার জেরে অস্ত্রোপচার হলে তাঁকে অজ্ঞান করার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিত্সকেরা। তাই দফায়-দফায় মন্ত্রীকে পরীক্ষা করা চলছে এবং কী ভাবে তাঁকে অজ্ঞান করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করছেন ডাক্তারেরা। তবে আপাতত মদনবাবুর অবস্থা স্থিতিশীল। স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করছেন।
সিবিআইয়ের জেরার জন্য মদনবাবুকে কি ছাড়বেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? দীপ্তেন্দ্রবাবু বলেন, “বিষয়টি কোনও একজন ডাক্তারের সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করছে না। আপাত ভাবে মনে হতে পারে সমস্যা নেই। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পরে আচমকা অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এ ধরনের রোগীর যখন-তখন যা কিছু হতেই পারে।”