বিশ্বাসের টানেই ‘ন্যায়’-এর আশায় পথ চেয়ে বসেছিলেন এক দশক ধরে। অবশেষে তিনি আইনের সাহায্য পেলেন। খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিলেন প্রধান বিচারপতি। জানালেন, শগুফতার অভিযোগ খতিয়ে দেখে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিজেই নিজের মামলার শুনানিতে অংশ নেন শগুফতা সুলেমান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেউ কথা না শুনলে কোর্ট শুনবে! শুনবে আর ‘ন্যায়’ দেবে!
কথাগুলোর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন ৩২ বছরের সুলেমান। শগুফতা সুলেমান। বিশ্বাসও করেন! সেই বিশ্বাসের টানেই ‘ন্যায়’-এর আশায় পথ চেয়ে বসেছিলেন এক দশক ধরে। অবশেষে তিনি আইনের সাহায্য পেলেন। খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিলেন প্রধান বিচারপতি। জানালেন, শগুফতার অভিযোগ খতিয়ে দেখে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। উপযুক্ত নিরাপত্তা দিতে হবে তাঁকে। আইনের কাছে তাঁর এই অধিকারটুকু রয়েছে।
‘ভারতে এখনও দু’জন ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া, গন্ডগোল হলে অনেকে বলেন — আপনাকে তো কোর্টে দেখে নেব! কেন লোকে বলেন এমন? কারণ, লোক আজও ভরসা করে। ভরসা করে বিচারব্যবস্থার উপর। পুলিশ, প্রশাসন, সরকার কথা না শুনলে, কোর্ট শুনবে তাঁর কথা! শুনবে আর ন্যায় দেবে’ — বিচারকের আসনে বসা সৌরভ শুক্লর মুখে এই সংলাপ শোনা গিয়েছিল সুভাষ কপূরের ‘জলি এলএলবি-২’ সিনেমাতে। নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে যেন ওই সংলাপটিই বার বার শক্তি জুগিয়েছে শগুফতাকে। তাঁর আশা, ‘‘আজ হোক বা কাল— বিচার আমি পাবই!’’
শগুফতা সুলেমান। —নিজস্ব চিত্র।
আইনের কোনও ডিগ্রি নেই। টাকা দিয়ে আইনজীবী নিয়োগ করতেও পারেননি। ফলে নিজেই নিজের মামলার শুনানিতে অংশ নেন শগুফতা। প্রধান বিচারপতির এজলাসে চিৎকার করে কাঁদো-কাঁদো গলায় সওয়াল, ‘‘ধর্মাবতার! পুলিশ আমাকে পাগল বলছে! আমার ফোন নম্বর ব্লক করে দিয়েছে। মাকে হারিয়েছি। ন’বছর ধরে সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছি। এ বার আপনারা সাহায্য করুন। না হলে আমাকেও ওরা প্রাণে মেরে দেবে।’’
সম্ভবত এমন ভাবে সওয়াল শুনতে অভ্যস্ত নন বিচারপতিরা। ডিভিশন বেঞ্চে বসে প্রধান বিচারপতি তাই আলোচনা করেছেন পাশের আসনে বসা বিচারপতির সঙ্গে। তার পরই এসেছে নির্দেশ। যথাযথ নিরাপত্তার পাশাপাশি শগুফতার অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে দেখার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। রায়ের পর শগুফতা বলছেন, ‘‘অবশেষে কোর্ট শুনল আমার কথা। যদিও স্বস্তি পেলাম না। কিন্তু শেষ অবধি আমার লড়াই জারি থাকবে।’’
ঘটনার সূত্রপাত ২০০৯ সালে। কলকাতার রিপন স্ট্রিটের বাসিন্দা শগুফতা। তাঁর মা হৃদ্যন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসক বলেছেন, মায়ের হৃৎপিন্ডে একটি ফুটো রয়েছে। তাই ধুলো, বালি, গুঁড়ো, ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে। সেই মতো মায়ের যত্ন নিচ্ছিলেন মেয়ে।
কিন্তু ২০১৩ সালে তাঁদের ঘরের লাগোয়া একটি পুরনো বাড়ি ভাঙা শুরু হয় বহুতল গড়ার জন্য। বাড়ি ভাঙার ফলে ধুলো, বালি, গুঁড়ো ঢুকে যাচ্ছিল শগুফতাদের বাড়িতে। ফলে শ্বাসকষ্টে বেড়ে যাচ্ছিল মায়ের অসুস্থতা। দায়িত্বে-থাকা প্রোমোটারের কর্মীদের অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হয়নি। শেষে স্থানীয় পার্ক স্ট্রিট থানার দ্বারস্থ হন শগুফতা। তাঁর অভিযোগ, সমস্যা শুনে পাত্তাই দেয়নি থানার পুলিশ। তার পর কলকাতা পুরসভাকে বিষয়টি বলা হয়। সেখান থেকেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
শগুফতার দাবি, ‘‘কিছু দিন পরে দেখি আমাদের জায়গাটাও দখল হয়ে নির্মাণ শুরু হয়েছে। বিরোধিতা করতে গেলে আমাদের প্রাণে মারার হুমকি দেন প্রমোটার। ফের পুরসভায় যাই। অন্য এক সূত্র মারফত জানতে পারি, ওই নির্মাণটি বেআইনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পুরো বিষয়টি জেনে তৎকালীন ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদকে বলি। তিনি সাহায্য করার পরিবর্তে আরও সমস্যায় ফেলেন। তৎকালীন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাড়ির পানীয় জলের সংযোগ বন্ধ করে দেন। সেদিন পুলিশ-প্রশাসন কথা শোনেনি। অগত্যা আদালতের দ্বারস্থ হই।’’
শগুফতার মামলার ইতিহাস বলছে, ২০১৪ সালে হাই কোর্ট ওই নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু অভিযোগ, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ‘পুলিশের সাহায্যে’ নির্মাণ চালিয়ে যান প্রোমোটার। হাই কোর্টে যাওয়ার কারণে তাঁকে মারার চক্রান্ত করা হয় বলেও অভিযোগ শগুফতার। সেই আশঙ্কায় তৎকালীন ডিসি সাউথ মুরলিধর শর্মার কাছে দ্বারস্থ হন তিনি। তার পর তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পাশাপাশি, রাশ টানা হয় ওই নির্মাণকাজের উপরও। যদিও শগুফতার দাবি, ‘‘ওই শান্তি বেশি দিন ছিল না। দু’বছরের মাথায় পুলিশে রদবদলের সঙ্গে পরিস্থিতির বদল ঘটে। নিরাপত্তা উঠে যায়। আমাদের উপর অত্যাচার বাড়ে। মানসিক ভাবে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মা মারা যান। আর লুকিয়ে চলে নির্মাণকাজ।’’
কলকাতা উচ্চ আদালত যখন পর পর কয়েকটি মামলায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দিচ্ছে, তখন ফের সেখানে যান শগুফতা। মামলা দায়ের করেন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চে। এক বছর ধরে মামলাটি সেখানে পড়ে থাকার পর মার্চের প্রথম সপ্তাহে শুনানি জন্য ওঠে। তখনই হাই কোর্ট কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ওই বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
তবে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি বলে জানাচ্ছেন রিপন স্ট্রিটের বাসিন্দা শগুফতা। বাড়ির পাশের নির্মাণটি যে ‘বেআইনি’, তা প্রমাণ করতে মরিয়া তিনি। শগুফতার বক্তব্য, ‘‘যা হারানোর হারিয়ে ফেলেছি। মাকে হারিয়েছি, চাকরি হারিয়েছি। এখন আর ভয় কিসের? ব্যক্তিগত ভাবে বিষয়টা আর দেখি না। এখন একটা অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আমার লড়াই। বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা রয়েছে। সত্যিটা এক দিন সামনে আনবই। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও আইন আমাকে ন্যায় দেবে। দেবেই!’’