হাতে আছে আর হাজার দুয়েক কন্টেনার রাখার জায়গা। পরিস্থিতি যা, তাতে আর দিন চারেকের মধ্যেই ওই জায়গা ভরে যাবে। তখন আর কলকাতা বন্দরে কোনও জাহাজ ঢুকতে চাইবে না। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, কলকাতায় যে-সব জাহাজ আসে, তার একটি অংশ পূর্ব উপকূলের পারাদীপ, বিশাখাপত্তনমের মতো বন্দরে চলে যেতে পারে।
রাজ্য সরকার কিন্তু দিনের বেলায় বন্দর এলাকায় লরি-ট্রেলার নিয়ন্ত্রণে অনড়। এই অবস্থায় ফেডারেশন অব পোর্ট লরি অ্যান্ড ট্রেলার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সোমবার জানিয়েছে, আজ, মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দর এলাকার সব লরি ও ট্রেলার ধর্মঘটে নামছে। সংগঠনের এক মুখপাত্র জানান, বৃহস্পতিবার তাঁরা কলকাতা পুলিশের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আলোচনার পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। এ দিন মন্ত্রীর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসেন সংগঠনের নেতারা। কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় বন্দরের প্রায় ২০ হাজার লরি ও ট্রেলার মঙ্গলবার থেকে চলবে না। এই ধর্মঘটে বন্দর এলাকার কাজে যুক্ত ঠিকা শ্রমিকেরাও সামিল হবেন বলে ওই সংগঠনের দাবি।
প্রায় দশ দিন ধরে কন্টেনার জমতে থাকায় ফের দিনের বেলায় লরি-ট্রেলার চলাচলের অনুমতি দেওয়ার জন্য বন্দরের চেয়ারম্যান টি কৃষ্ণবাবু এ দিনই রাজ্য সরকারের কাছে আর্জি জানান। বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা পুলিশের কাছেও এই আবেদন জানাবেন তাঁরা। বন্দরের পরিস্থিতি নিয়ে এ দিন দফায় দফায় বৈঠক করেন চেয়ারম্যান।
পুরমন্ত্রী ও স্থানীয় বিধায়ক ফিরহাদ হাকিম অবশ্য এই অবস্থার জন্য বন্দরকেই দায়ী করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য বন্দরই দায়ী। পাঁচ বছর ধরে ওদের রাস্তা সারাতে এবং পার্কিং লট তৈরি করতে বলা হয়েছে। ওরা তা কানে তোলেনি। এক বছরে এখানে ৩০ জন মারা গিয়েছেন। মানুষের জীবন অনেক মূল্যবান। বন্দর পরিকাঠামো তৈরি না-করলে সরকারও তাদের কঠোর অবস্থানই বজায় রাখবে।’’
বন্দরকর্তাদের দাবি, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রেলার-লরি ঢোকার অনুমতি না-মিললে রাজ্যে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে। নিষেধাজ্ঞার জেরে পড়শি দুই দেশ নেপাল ও ভুটানের যাবতীয় পণ্য পরিবহণ এবং সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান তাঁরা।
বন্দর এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পুলিশি নির্দেশে বলা হয়েছে, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই এলাকায় কোনও লরি বা ট্রেলার চলাচল করতে পারবে না। সেই নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই বন্দরে পণ্য ওঠানামার কাজে কার্যত ধস নামতে শুরু করেছে। যত দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ বন্দর-কর্তৃপক্ষের।
কী ভাবে?
বন্দরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ফলে রোজ দিনের বেলায় গড়ে ৩৫০টি কন্টেনার বন্দর থেকে বেরোতে পারছে না। এর ফলে বন্দরের বিভিন্ন বার্থে প্রায় ৬৫০০টি কন্টেনার জমে গিয়েছে। কর্তাদের দাবি, নেতাজি সুভাষ ডকে সাড় আট হাজার কন্টেনার রাখার ব্যবস্থা আছে। দিন দিন যে-ভাবে মজুত কন্টেনারের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সব বার্থ পূর্ণ হতে আর চার-পাঁচ দিন লাগবে। তখন চাইলেও বন্দরে আর কোনও জাহাজ আনা সম্ভব হবে না।
পরিণাম কী হতে পারে, তা জানাচ্ছেন এক বন্দরকর্তা। তিনি বলছেন, পুজো এবং দীপাবলির আগে এ ভাবে পণ্য সরবরাহ বাধা পেলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে। কলকাতা, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জন্য জামাকাপড়, জুতো থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যই আসে কন্টেনারে। নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো গন্তব্যে না-পৌঁছলে পণ্যের দাম বাড়তে বাধ্য। নেপাল-ভুটানের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে।’’
বন্দরে কন্টেনার জমতে থাকায় নেপাল-ভুটানে পণ্য পরিবহণও ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরের খবর, প্রতি মাসে নেপালে ৫০০০ এবং ভুটানে ১৫০টি কন্টেনার যায়। এখন নেপালে দৈনিক ১০০টি কন্টেনার কম যাচ্ছে। এতে রোজ পাঁচ লক্ষ টাকা বাড়তি গুনাগার দিতে হচ্ছে পরিবহণ সংস্থাগুলিকে। নেপালে পণ্য সরবরাহকারী সংস্থাগুলির মুখপাত্র প্রদীপ অগ্রবাল জানান, নেপাল থেকে যে-সব খালি কন্টেনার ফিরছে, দিনের বেলায় ট্রেলার ঢোকা বন্ধ থাকায় সেগুলিও জাহাজ সংস্থার গুদামে পাঠানো যাচ্ছে না। ‘‘আমরা বন্দরকে জানিয়েছি, সাত দিনে পরিস্থিতি না-বদলালে নেপালের পণ্যও অন্য বন্দরে নিয়ে যেতে হবে,’’ বললেন অগ্রবাল।
সরকার অবশ্য বন্দর-কর্তৃপক্ষ এবং পণ্য সরবরাহকারীদের কোনও যুক্তিই মানতে রাজি নয়। ‘‘বন্দর-কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃত ভাবে গোলমাল পাকাচ্ছেন। রাতে কাস্টমসকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। অথচ সারা রাত কাজ হলে কোনও ট্রেলারই আটকে থাকার কথা নয়,’’ বলছেন ফিরহাদ।