তৃতীয় নয়ন

পিঁপড়ের সারি, কামড়ালে কিন্তু জ্বালিয়ে দিতে পারে

এই ভোট শুধু আমাদের দেশ সামনের বছরগুলোয় কোন দিকে যাবে সেটার নির্ণায়কই নয়, এই ভোট ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা পূরণের দিকে তাকিয়ে থাকার ভোটও! এমনটাই বলছিল বছর আঠাশের যুবক সুরজিত।

Advertisement

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০৩
Share:

এ বছরের লোকসভা ভোট তরুণ ভারতবর্ষের ভোট। গ্রামে-গঞ্জে, মফস্‌সলে বা শহরে ছড়িয়ে থাকা নানান আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্যে জীবনধারণ করা যুবক-যুবতীদের কাছে এই ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ভোট শুধু আমাদের দেশ সামনের বছরগুলোয় কোন দিকে যাবে সেটার নির্ণায়কই নয়, এই ভোট ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা পূরণের দিকে তাকিয়ে থাকার ভোটও! এমনটাই বলছিল বছর আঠাশের যুবক সুরজিত।

Advertisement

আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, কলকাতা থেকে সামান্য দূরের একটা ছোট্ট শহরের সুন্দর নদীর ধারে। সামনে দিয়ে মোটরবোট লোক নামিয়ে-উঠিয়ে চলাচল করছিল এপার ওপার। হাওয়া দিচ্ছিল খুব। সেই হাওয়ায় সামান্য দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকে যুবক-যুবতীদের ওড়না আর পাঞ্জাবির কোণা উড়ছিল অল্প অল্প! সুরজিত এখনও চাকরি পায়নি। সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। সারাদিন প্রায় বাড়ির বাইরে থাকে। তা-ও বাড়ির চাপ বুঝতে পারে! চাকরি পাওয়ার চাপ! সুরজিত কথা বলতে বলতে আমায় হাত ধরে সরিয়ে দিয়েছিল এক পাশে। বলছিল, সরে আসুন দাদা ওই দেখুন লাল পিঁপড়ের লাইন আপনার পায়ের কাছে! কামড়ালে কিন্তু জ্বালিয়ে দেবে!

আমি সরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম একটা বকুল গাছের নীচে। সুরজিত বলছিল, সে ভাবে তো কোনও চাকরি নেই চারদিকে। এই যে সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোকে দেখছেন, এদের এ ভাবে চুপচাপ বসে থাকার সংখ্যা দিনকে দিন আরও বাড়বে, যদি না কেউ সিরিয়াসলি যুব সম্প্রদায়ের কথা ভাবে। এরা যত না এখানে প্রেম করতে আসে, তার চেয়ে বেশি আসে সমাজের চাপ থেকে সরে এসে একটু শান্তি পেতে। বেসরকারি মতে, আমাদের দেশে দু’হাজার সতেরোর বেকারত্ব ছিল সাড়ে তিন শতাংশ আর দু’হাজার আঠেরোয় সেটা হয়ে গিয়েছে ছয় দশমিক এক! এটা খুবই চিন্তার ব্যাপার! সুরজিত থেমেছিল একটু। রুমাল বের করে ঘাম মুছে বলেছিল, তবে এটা বলতে হবে, সরকারের আনা শিক্ষার খাতে নানান প্রকল্পের ফলে স্কুল-মুখী হয়েছে মানুষ। অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষ পড়তে পারছে। কিন্তু শিক্ষা পাওয়ার পরে চাকরির ক্ষেত্রে গিয়ে যে ‘বটল নেক’ তৈরি হচ্ছে, সেটা খুব চিন্তার! তবে তার চেয়েও চিন্তার ব্যাপার হল সারা দেশ জুড়ে মানুষের মধ্যের বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা চালানোটা। আসলে সবটাই তো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত! অস্থিরতা থাকলে সেই দেশে কেউ নতুন করে লগ্নি করে না। আর কে না জানে, নতুন লগ্নি না এলে বেকারত্বের সমস্যা মিটবে না!

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অনেকটা একই রকম কথা বলছিল সফিকুল। নদিয়ার সীমান্তবর্তী এক গ্রামে থাকে সে। বাবা-মা, দুই দাদা-বৌদি আর ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে সংসার। বাড়ির মধ্যে কেবল সফিকুলই কলেজ-ইউনিভার্সিটি গিয়েছে। এম.এ পাশ করেছে বাংলায়। সফিকুলের বাবা-দাদারা পেশায় কৃষক। ধান, পাট, পেঁয়াজ, শশার চাষ করেন। সরকারের কৃষকদের জন্য যে সব ব্যবস্থা করেছেন, তাতে কৃষকদের সুবিধে হচ্ছে। কৃষকবন্ধু প্রকল্প ধীরে ধীরে হলেও কৃষকদের সাহায্য করছে। সফিকুলের বাবা দাদাকেও করেছে। বলছিল সফিকুল। তবে এও বলছিল, এ বার পেঁয়াজ আর পাট চাষের অবস্থা শোচনীয়। চাষের ন্যূনতম দামটাও ওঠেনি। মহাজন আর ফড়েদের দৌরাত্ম্যটাও কমানো দরকার।

সফিকুল চাকরি পায়নি এখনও। গ্রামের বাচ্চাদের প্রাইভেটে পড়ায়। তার সঙ্গে বাবা-দাদাদের চাষেও সাহায্য করে। আমাদের সামনে শশা ঝাড়াই বাছাই করে বস্তায় ভরা হচ্ছিল। এই সব নাকি যাবে শিয়ালদার মার্কেটে। সফিকুল কাজের তদারকির মাঝখানেই বলছিল, ‘‘জানেন দাদা, কোনও কাজই ছোট-বড় নয়, কিন্তু শিক্ষার একটা প্রযোজ্যতা তো আছে। আমি এতটা পড়াশুনো করে যদি শেষে এই কাজই করব, তা হলে আরও আগে থেকেই করতে পারতাম! চারদিকে এত অশান্তি কেন জানেন? রোজগার নেই তাই! গ্রামের শেষে আগুন লাগলে যেমন গ্রামের মধ্যেকার রাজবাড়ি বাঁচে না, তেমন পেটে আগুন লাগলে মাথাতেও লাগতে সময় লাগে না।’’

‘‘ন্যায়-অন্যায় বুঝি না। দাদা বলেছেন, তাই যেভাবে হোক জিততে হবে, ব্যস!’’ কথা হচ্ছিল কলকাতা থেকে সামান্য দূরের আরেক ছোট শহরের ছেলে মনোজের সঙ্গে। এলাকার দোর্দণ্ড-প্রতাপ দাদার স্নেহধন্য মনোজ এলাকায় ডাকাবুকো, মানে, ফিসফিসে গলায় ‘মাস্তান’ বলে পরিচিত। এইচ.এস-এ ইতিহাসে ‘ব্যাক’ ছিল মনোজের। তারপর সে গোটা পড়াশুনোটাকেই ইতিহাস করে দিয়েছে। মনোজের হাতে আর গলায় মোটা সোনার চেন। কানে দুল। গায়ে যে টি-শার্ট তার দাম হাজার তিনেকের কম নয়। যে বাইকের ওপর বসে আমার সঙ্গে কথা বলছিল, সেটাও বেশ নজর কাড়া। আমি চা খাই না জেনেও মজা করে আমায় চা খাওয়াবার জন্য জোর করছিল মনোজ। হাসছিল হা হা করে। দূরে পার্টির ছেলেরা মিছিলের তোড়জোড় করছিল দেখছিলাম। প্রতাপশালী দাদাটি এসে পৌঁছলেই মিছিল ও জয়ধ্বনি শুরু হবে। তারই ফাঁকে মনোজ বলছিল, ‘‘এই সব যা ঝিকিরমিকির সোনা দেখছেন, সব দাদার জন্য। না হলে এই বাজারে এই বিদ্যে নিয়ে চাকরি পেতাম নাকি! কত শিক্ষিতরা সরকারি ডি গ্রুপের চাকরির জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে আছে! দাদার কাছেই তো কত শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা একটা চাকরির জন্য আসে। আমাকে ‘স্যার স্যার’ করে! বলে দাদাকে একটু বলে দিতে, মনে করিয়ে দিতে। আমি নাকি ‘স্যার’!’’ মনোজ হাসছিল মাথা তুলে! তারপর আচমকা হাসি থামিয়ে ম্লান মুখে বলেছিল, ‘‘সবাই সামনে তেল দিলেও পেছনে গুন্ডা বলে আমায়, সে কি জানি না! কিন্তু কী করব! বোনটার বিয়ে দিতে হবে। বাবা মায়ের চিকিৎসার খরচ! আমরা সবাই কি আর মেধাবী যে নানান পরীক্ষা দিয়ে টপাটপ চাকরি পেয়ে যাব? বিদেশে চলে যাব? আমাদেরও তো বেঁচে থাকতে হবে! আমাদের মতো কাজও তো থাকা দরকার!’’

‘‘সব করাপ্ট! আমিই তো পি.এইচ.ডি করব স্টেটসে। এখানে কেউ থাকে নাকি! সারা দেশ জুড়ে যারা মঞ্চে ওঠে, ভাষণ দেয়, তাদের অধিকাংশের মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় সব কেমন মানুষ! আজকাল লোকে স্রেফ রোজগারের জন্য পলিটিক্স করে!’’ কথাটা বলে দিওতিমা সিগারেট ধরিয়ে পাশে তাকিয়েছিল সুরূপা, নীলাঞ্জনা, রজত আর অরিতের দিকে! আমরা দাঁড়িয়েছিলাম দক্ষিণ কলকাতার লেকের পাশের একটা অভিজাত খাবারের দোকানের সামনে। এখানে যুবক-যুবতীদের ভিড় লেগেই থাকে। ওরা বলছিল, এত করাপশান! রাস্তা তৈরি থেকে বাঁধ নির্মাণ! টেলিকম থেকে দেশের প্রতিরক্ষা! সব জায়গায় কাট মানি!
সরকারি চাকরি তলায় তলায় টাকা দিয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হাজারটা স্ক্যাম। ‘‘কোন পার্টিকে ভোট দেব বলুন তো? সবাই প্রতিশ্রুতি দেয়! কাজ করে না কেউ। তার ওপর ফালতু ফালতু রিলিজিয়াস পোলারিটি তৈরি করা হচ্ছে। যারা এর ফাঁদে পড়ে নাচছে, তারা বুঝতে পারছে না যে ওদের ইউজ করছে ওপরের লোকগুলো। আরে বাবা, খিদে পেলে কি ধর্ম ধুয়ে জল খাবে! আমি তো স্রেফ চলে যাচ্ছি। যারা পপুলেশান কন্ট্রোল না করে আরও বাড়াবার কথা বলে! জনবিস্ফোরণের খারাপ দিকটা চেপে রেখে সেটাকে নিয়ে নিজেদের স্বার্থে এজেন্ডা সাজায় তাদের মানব কেন? মানুষের ঠিক মতো কাজ থাকলে এ সব ব্যাপারে তারা মাথা ঘামাত নাকি? খালি মস্তিষ্ক কিসের যেন কারখানা! আমি তো চলে যাবই!’’

দিওতিমাদের বড় বাড়ি। সফল বাবা-মা। এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া অবধি লম্বা গাড়ি! ওরা হয়ত পালিয়ে যাবে! কিন্তু মিনু? যার ছাব্বিশ বছর বয়সেই তিনটে বাচ্চা! যার বর দেড় বছর হল কোথায় যেন চলে গিয়েছে! বাবুর বাড়িতে কাজ করে যে কোনও মতে টিকে আছে! সে পালাবে কোথায়! এরাও কি এই দেশের যুব সম্প্রাদায় নয়! মিনু বলেছিল, ‘‘দাদা কী করব বুঝি না! বড় ছেলেটার থ্যালাসেমিয়া আছে। কত দিন বাঁচবে কে জানে!’’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্কুলে যায় না? কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর টাকা পাওনি তুমি? ব্যাঙ্কের বই হয়নি?

মিনু বলেছিল, ‘‘পাড়ার লোকজন পেয়েছে। আমাদের ব্যাঙ্কের বইও হয়েছে। বাচ্চারাও স্কুলে যায়। মিড ডে মিলে খেতে পায়। জামাকাপড় পায় স্কুল থেকে। কী শিখছে বোঝার মতো জ্ঞান আমার নেই দাদা। তবে সত্যি বলতে কি, খেতে পায় বলেই স্কুলে পাঠাই। আর আমি বাবুদের বাড়ির কাজ করি, সেই সময়টা ওরা কী করবে! তা ছাড়া স্কুলে যখন যায় নিশ্চয় কিছু শেখে। আমি চাই ওরা পড়ুক। আমার মতো যেন ওদের এই জীবন
কাটাতে না নয়।’’

আমি বলেছিলাম, সরকার তো চেষ্টা করছে। এত জনসংখ্যা! একটু সময় লাগবে হয়তো। আশা ছেড়ো না।

আশা! মিনু মাথা নিচু করে নিয়েছিল, তারপর বলেছিল, ‘‘আচ্ছা, আমাদের মতো মেয়েদের কিছু হয় না, না? মানে সারাজীবন বাড়ি বাড়ি কাজ করে যাব? আমাদের কোনও মিল-টিলে কাজ হবে না? চাকরি পেতে পারি না আমরা!’’

আমি কথার উত্তর দিতে পারি না। দেশ জোড়া লক্ষ লক্ষ বেকার হাতের কথা মনে পড়ে! লজ্জায়, কষ্টে মাথা নামিয়ে নিই। দেখি, ভোট আসছে। টাকা ভাসছে! প্রতিশ্রুতির রংমশাল, ফুলঝুরি উড়ছে! কিন্তু সুরজিত, সফিকুল, মনোজ, দিওতিমা, মিনুরাও বাড়ছে! আচ্ছা, তরুণ দেশের তরুণদের কথা কি সত্যি ভাববে কেউ? চাকরি পাবে এরা? তরুণ দেশের হাত ব্যস্ত থাকবে তো কাজে? গত লোকসভা নির্বাচনে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার ধারেকাছেও তো চাকরি হয়নি দেশে! তা হলে তরুণদের সম্মানজনক রোজগারের দিকটা কে দেখবে? কবে দেখবে?

লাল পিঁপিড়ের সারি চলছে। সারি দীর্ঘ হচ্ছে! ক্ষমতাবানরা কি ভুলে যাচ্ছেন সামান্য পিঁপড়ের মতো মনে হলেও, ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে এদের কামড় কতটা জ্বালিয়ে দিতে পারে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement