কাজ নেই। তাই চালু একটি মাত্র যন্ত্র। মেটিয়াবুরুজের কারখানায়। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘কত দিন যে দুটো মেশিন একসঙ্গে চালাই না। দরকারই পড়ে না!’’
পড়ন্ত বিকেলে মেটিয়াবুরুজের কারবালা রোডের পোশাক তৈরির কারখানায় বসে আক্ষেপ করছিলেন আহমেদ আলি মণ্ডল।
পশ্চিমবঙ্গে বস্ত্রশিল্পের অন্যতম ঠিকানা মেটিয়াবুরুজে কেউ গোটা পোশাক তৈরি করেন, কেউ বা পোশাকের অংশ বিশেষ। মূলত পরিবারকেন্দ্রিক এই ক্ষুদ্র শিল্পের কিছু কাজ বাড়িতে হয়, কিছু কারখানায়। পরিবারের সদস্যেরা যেমন দক্ষ কারিগর, তেমনই পশ্চিমবঙ্গ ও পড়শি রাজ্য থেকে আসেন অনেকে।
পোশাকের বিভিন্ন অংশের পাশাপাশি ‘বেবি ফ্রক’ও তৈরি করতেন আহমেদ আলি। সে সবের বরাত আসত দক্ষিণ ভারত, মহারাষ্ট্র থেকে। কিন্তু বরাতের অভাবে এখন ফ্রক তৈরি বন্ধ, অন্য পোশাকের চাহিদাও কমছে। তাই এমব্রয়ডারির একটি মেশিন চললে, বিশ্রামেই থাকে অন্যটি।
দর্জি ওস্তাগর ও সহায়ক কর্মী ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আলি ও সেক্রেটারি শেখ মহম্মদ জামিরের দাবি, নোট বাতিল এবং জিএসটির ধাক্কা রেশ এখনও কাটেনি বস্ত্রশিল্পে। এছাড়াও আহমেদের কথায়, ‘‘ভিন রাজ্যের যে সব সংস্থা আমাদের বরাত দিত, তারা বলছে সেখানে ফসল নষ্ট হওয়ায় মানুষের আয় কমেছে। কমেছে পোশাকের চাহিদা। এখানে উৎপাদনও কমেছে অন্তত ২৫%। দেশের বাড়ি ফিরে গিয়েছেন বহু কর্মী।’’ পাশ থেকে জামির বলে ওঠেন, ‘‘নিজেরাই কাজ পাচ্ছি না, কাকে কাজে নেব? পরিবারের লোক ছাড়াও ১৬ জন কর্মী ছিলেন আমার। এখন চার।’’
রাজ্যের এমন বহু ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প পরিবারকেন্দ্রিক। সেখানে যন্ত্রের চেয়ে কর্মীদের দক্ষতাই মূল কথা। যেমন মেটিয়াবুরুজ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে মগরাহাটের তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত— ধামওয়া উত্তর, ধামওয়া দক্ষিণ ও হোটর মোরজাদা বিখ্যাত রূপোর বাট থেকে গয়না তৈরির ‘ক্লাস্টা’র হিসেবে। ছোট ছোট প্রায় দু’হাজার বাড়িতে ছিল কারখানা। ক্লাস্টারের সেক্রেটারি উত্তম হালদারের দাবি, প্রায় অর্ধেক এখন বন্ধ। কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকেই রাজমিস্ত্রি বা রঙের মিস্ত্রি।
বাড়ির কারখানায় কাজ করছিলেন উত্তমবাবুর বাবা বকুল হালদার। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই কাজ করা মানুষটির কথায়, ‘‘জিএসটি আর নোটবন্দির পরে কাজ প্রায় অর্ধেক। আগে দিনে গড়ে দেড় কিলো রূপোর গয়না গড়তাম। এখন পাঁচ দিন কাজ থাকে তো পরের পাঁচ দিন শুধুই বসে থাকা।’’ পড়শি মাধাই চন্দ্র হালদার বছর ছয়েক আগে চলে গিয়েছেন রঙের কাজে। সেখানে রোজ কাজ মেলে এমন নয়। সেদিনও তাই বাড়িতেই ছিলেন। তবুও জানালেন, গয়নার পারিবারিক ব্যবসায় আর ফিরতে চান না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আহমেদ আলি, উত্তমবাবুরা ব্যাখ্যা করেন, এ ধরনের ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প সাধারণত নগদের উপর নির্ভরশীল। আচমকা পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হওয়ায় মূলধনে টান পড়েছিল। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘কালো টাকার হদিস কি মিলল? বরং আমাদের উপর কোপ পড়ল।’’ তাঁদের দাবি, দ্বিতীয় ধাক্কা দিয়েছিল জিএসটি। কেউই কর ব্যবস্থার বিরোধী না হলেও অভিযোগ, জিএসটি রূপায়ণে ছোট শিল্পের সমস্যা গুরুত্ব পায়নি। বেশিরভাগেরই সামান্য পুঁজির ব্যবসা। অনলাইনে রিটার্ন জমা তো দূরের কথা, কম্পিউটার সম্পর্কেই অনভিজ্ঞ বেশিরভাগ।
জিএসটিতে তো ছোট শিল্পের ছাড় রয়েছে! উত্তমবাবুর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘সে ছাড় পাওয়ার কাগজ তৈরি করতেও তো আলাদা কর্মী রাখতে হবে। ক’জনের পক্ষে তা সম্ভব?’’ এছাড়া, তাঁদের দাবি, এমন ছোট ব্যবসায় জিএসটির প্রয়োগে পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। অনেকেই বড়বাজারে মহাজনদের কাজের বরাতের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় আলাদা করে রূপোর গয়না নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু সেখানে কে তা কিনবেন, সব সময় তার আগাম নিশ্চয়তা থাকে না। ফলে তৈরি করা যায় না জিএসটি চালানও। উত্তমবাবুর প্রশ্ন, ‘‘এই ধরনের জটিলতা কাটানোর উদ্যোগ কই?’’
জিএসটির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে দাবি বারুইপুরের সার্জিকাল যন্ত্র তৈরির শিল্পের কারিগর তথা মালিক প্রবীর চট্টোপাধ্যায়, সুশান্ত কর্মকার, কমল দাসদেরও। ফুলতলায় এই শিল্পের প্রসারে ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ তৈরির জন্য কেন্দ্র-রাজ্য এক সময় উদ্যোগী হলেও সেই পরিকাঠামো কার্যত প্রাথমিক স্তরেই পড়ে রয়েছে। সেখানে কাজে আসা, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানালেন, বছর তিনেক ধরে তাঁদের বেতন বাড়েনি। ফলে সুযোগ পেলে অনেকেই কাজ ছেড়ে দেন। রাজমিস্ত্রির কাজে দৈনিক ৪০০ টাকার মজুরি পেলেও সার্জিকাল শিল্পে মেলে বড়জোড় ২৫০ টাকা। জিএসটি বা নোট বাতিলই শুধু নয়, দীর্ঘ দিন ধরেই এই শিল্পের বাধা পাকিস্তান ও চিন থেকে আমদানি হওয়া সস্তার সার্জিকাল যন্ত্রও। সব মিলিয়ে আগে প্রায় ৬০০টি কারখানা থাকলেও এখন তা প্রায় অর্ধেক।
সস্তার আমদানি একই ভাবে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে বারুইপুরের ধূপকাঠিকেও। উপরন্তু ২০০৭ সালে ভ্যাটে ছাড় পেলেও জিএসটিতে নতুন করে কর বসেছে। সেখানকার আগরবাতি ক্লাস্টারের কর্তা পূর্ণেন্দু লাহিড়ি জানালেন, আগে সুগন্ধী ধূপকাঠির পুরোটাই তৈরি হত ওই অঞ্চলে। এরপর মূল কাঁচামাল— বাঁশকাঠি আসতে থাকে চিন থেকে। গাছের ছাল (যা দিয়ে আঠা হয়), পাউডার ইত্যাদি কাঁচামাল ছাড়াও সুগন্ধী ছাড়া মশলা মাখানো অনেক সস্তার ধূপকাঠি রফতানি শুরু করে ভিয়েতনাম। এগুলি ‘র-কাঠি’ বলে পরিচিত। বারুইপুরের কারখানাগুলির বেশিরভাগই র-কাঠিতে শুধুমাত্র সুগন্ধী মিশিয়ে বিক্রি করে। আরও অনেকের মতো পূর্ণেন্দুবাবুও এখন কারখানা গুটিয়ে আমদানি নির্ভর ব্যবসাতেই পা রেখেছেন। বন্ধ করে দিয়েছেন জলপাইগুড়িতে তাঁদের বাঁশকাঠি তৈরির কারখানা। জানালেন, সেখানে হাজার পাঁচেক কর্মী কাজ করতেন। গত কয়েক বছরে বারুইপুরের ব্যবসাতেও নতুন কর্মী নিয়োগ হয়নি।
এমনই অনিশ্চয়তায় বিকল্প পথ খুঁজতে বছর ছয়েক আগে বারুইপুরের সার্জিকাল শিল্পের ৩২ বছরের অভিজ্ঞ কর্মী হাসিম আলি লস্কর হাতে তুলে নিয়েছিলেন কেটলি আর চা। দাবি করলেন, দৈনিক আয় তো বেড়েছেই, চৈত্র সেলের মতো বিশেষ সময়ে পকেটে আসে বাড়তি দু’পয়সা।
শিল্পের বদলে তাহলে ভরসা চা আর কেটলি?