বর্ধমানের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনের সাঁইবাড়ি। ছবি: উদিত সিংহ
অর্ধশতাব্দী পেরোতে চলল। বর্ধমানের রাজনীতিতে আবারও চর্চায় সাঁইবাড়ির হত্যাকাণ্ড। লোকসভা ভোটের আবহের মধ্যে আজ, রবিবার সেই ঘটনার বর্ষপূর্তি। তৃণমূলের তরফে সাঁইবাড়ির সামনে একটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে আজ। সেখান থেকেই প্রচার শুরু করার কথা দলের বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের প্রার্থী মমতাজ সংঘমিতার। যদিও কমিশন গড়ে ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করিয়ে, তৃণমূল-সরকার তা প্রকাশ্যে আনেনি বলে তারা প্রচার করবে, এমনটাই দাবি বিজেপির।
১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ বর্ধমান শহরের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনে খুন হন দুই ভাই—মলয় ও প্রণব সাঁই। তাঁদের সঙ্গে নিহত হন সেই সময়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছাত্র জিতেন রায়। তিনি ওই বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করতেন। মামলায় নিরুপম সেন, বিনয় কোঙার-সহ সিপিএমের বহু নেতা-কর্মী অভিযুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই ঘটনার তদন্তে তারাপদ মুখোপাধ্যায় কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে বামফ্রন্ট সরকার ওই বিষয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। তাই মুখোপাধ্যায় কমিশন তদন্ত-রিপোর্ট দিলেও বিচার মেলেনি বলে অভিযোগ সাঁই পরিবারের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে, প্রাক্তন বিচারপতি অরুণাভ বসুকে চেয়ারম্যান করে ফের একটি কমিশন গড়া হয়। তিনি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাঁইবাড়ি ঘুরেও দেখেন। ওই কমিশনে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন জিতেন রায়ের ভাইপো, মঙ্গলকোটের বাসিন্দা চিরকুমার রায়। তিনি বলেন, “পরের কমিশনটির রিপোর্ট প্রকাশ পেলেও ভাল লাগত।’’
নিহত দু’ভাইয়ের দিদি, বর্ধমান শহরের বাদামতলার বাসিন্দা স্বর্ণলতা যশের খেদ, “চোখের সামনে দুই ভাইয়ের খুন হতে দেখার বিচার হল না। সে কথা ভাবলেই চোখে জল আসে।’’ কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টে বিচার চেয়ে মামলা করেছিলেন সাঁইবাড়ির সদস্যেরা। তাঁদের আইনজীবী জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “শুনেছি, অরুণাভ বসু কমিশন রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্ট প্রকাশ না হলে ফের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হব।’’
ঠিক কী ঘটেছিল সাঁইবাড়িতে? স্বর্ণলতাদেবীর অভিযোগ, “পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জানলা দিয়ে বড়-বড় ইট ছোড়া হচ্ছিল। রান্নাঘরে ঢুকে প্রণব আর জিতেনকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে-পিটিয়ে খুন করা হয়। পাশের বাড়িতে খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা মলয়কে বার করে খুন করা হয়।’’
সেই সময়ে নিহতদের ভাই উদয় সাঁই নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তাঁকে পড়াতে এসেই জিতেনবাবু খুন হন বলে অভিযোগ। উদয়বাবুর অভিযোগ, “আমার মা মৃগনয়নাদেবী ছেলেদের বাঁচাতে গিয়ে রক্তাক্ত হন। ওই অবস্থায় মায়ের মুখে রক্তমাখা ভাত ছুড়ে দিয়েছিল আততায়ীরা।’’ তাঁরও আবেদন, “কমিশনের রিপোর্ট দ্রুত প্রকাশ হোক।’’
কংগ্রেসের জেলা কার্যকরী সভাপতি কাশীনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বর্ধমানের রাজনীতিতে সাঁইবাড়ির মতো অমানবিক ঘটনা ঘটেনি। তাই ঘটনার ৫০ বছর পরেও তা চর্চার বিষয়।’’ বিজেপি-র বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের সভাপতি সন্দীপ নন্দীর বক্তব্য, “তৃণমূল রাজনীতি করতে দ্বিতীয় কমিশন গড়েছিল। তাই ওরা সে রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। সেটা আমরা এ বার প্রচারে তুলে ধরব।’’
অরুণাভ বসু কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়েছে কি না বা রিপোর্ট জমা পড়লে তা প্রকাশ পায়নি কেন— সে সব প্রশ্নে তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘এ নিয়ে মন্তব্য করব না।’’ তবে তিনি বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সিপিএমের সঙ্গে বিজেপি কী ভাবে আঁতাঁত করেছে, ভোটের-প্রচারে তা বলা হবে।’’
জেলার সিপিএম নেতা অমল হালদারের প্রতিক্রিয়া, “তৃণমূলের সরকার কত কিছু করল! এ সব কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।”