কর্মী নেই, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিধিরাম পর্ষদ

শিল্পাঞ্চলে দূষণের বিরাম নেই। তবে তার খুঁটিনাটি যাচাই করার জন্য যাঁদের থাকাটা একান্ত জরুরি, নেই তাঁরাও। কর্মী-আধিকারিকের বালাই নেই। নেই কোনও দূষণের খুঁটিনাটি জানা বিশেষজ্ঞও। ম্লান গ্লোসাইন হোর্ডিংয়ে তবু রয়ে গিয়েছে দুর্গাপুরের আঞ্চলিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দফতর।

Advertisement

সুব্রত সীট

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৪
Share:

প্রায়শই দেখা যায় এমন ছবি। দুর্গাপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শিল্পাঞ্চলে দূষণের বিরাম নেই। তবে তার খুঁটিনাটি যাচাই করার জন্য যাঁদের থাকাটা একান্ত জরুরি, নেই তাঁরাও।

Advertisement

কর্মী-আধিকারিকের বালাই নেই। নেই কোনও দূষণের খুঁটিনাটি জানা বিশেষজ্ঞও। ম্লান গ্লোসাইন হোর্ডিংয়ে তবু রয়ে গিয়েছে দুর্গাপুরের আঞ্চলিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দফতর। যা শুধু দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল নয়, তত্ত্বাবধান করে বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকা এবং পড়শি জেলা বীরভূম ও বাঁকুড়ার শিল্পাঞ্চলেরও।

গুঁড়ো কয়লায় হাঁসফাঁস, স্পঞ্জ আয়রনের দৌরাত্ম্যে নাভিশ্বাস ওঠা স্থানীয় বাসিন্দাদের আর্জি তাই— ‘লোক নেই, কী করব বলুন’, গোছের দায়সারা উত্তরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।

Advertisement

দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে দূষণের বিভিন্ন রকমফের। বাতাসে ধাতব কণা নিয়ে বছরভর শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর সংখ্যা সেখানে বাড়ছে। বাঁকুড়ার বড়জোড়া লাগোয়া বসতেও স্পঞ্জ আয়রনের দাপটে সে সমস্যা ভয়ঙ্কর। তা নিয়ে বিক্ষোভে বার কয়েক পর্ষদের অভিযানও হয়েছে ওই সব কারখানায়। দূষণ রোধক যন্ত্র বসানোর আশ্বাসে সে কারখানা চালু হলেও সেই প্রতিশ্রুতি অবশ্য শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি।

স্বাধীনতার আগে দুর্গাপুরে স্টেশনের পাশে মার্টিন বার্ন গ্রুপের একটি মাত্র কারখানা ছিল। ১৯৫৫ সালে ডিভিসি গড়ে তোলে দুর্গাপুর ব্যারাজ। তার পরেই মায়াবাজারে গড়ে ওঠে দুর্গাপুর থার্মাল পাওয়ার স্টেশন। একে-একে মাথা তোলে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট, দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড, অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট এবং তার পরে এমএএমসি, এইচএফসিএল, পিসিবিএল, বিওজিএল, গ্রাফাইট ইন্ডিয়া, ডিসিএল-সহ নানা শিল্পসংস্থা। শিল্পায়নের সঙ্গে শহরে দূষণের মাত্রাও এক ধাক্কায় বেড়ে যায়। তা দেখার জন্য সিটি সেন্টারের ক্ষুদিরাম সরণিতে গড়ে তোলা হয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আঞ্চলিক অফিস ও গবেষণাগার। নয়ের দশকে রাজ্যে নতুন করে শিল্পায়নের উদ্যোগ শুরু হওয়ায় দুর্গাপুরে বেশ কিছু বেসরকারি ইস্পাত কারখানা, স্পঞ্জ আয়রন, ফেরো অ্যালয় কারখানা গড়ে ওঠে। বাড়ে দূষণের মাত্রাও। অচিরেই দেশের প্রথম ২৫টি দূষিত শহরের মধ্যে জায়গা করে নেয় দুর্গাপুর। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আঞ্চলিক অফিসের কাজকর্মও বেড়ে যায়। তার বাইরে বাকি বর্ধমান জেলা এবং পাশ্ববর্তী বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বও বর্তায় তার উপরে।

পর্ষদের এই আঞ্চলিক অফিস থেকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা নিরন্তর নিরীক্ষণ, চালানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়ার কথা। কিন্তু পর্ষদের কথায়—‘‘লোক কোথায়, কে দেখবে?’’ স্থানীয় কল-কারখানার পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দা এবং শ্রমিকদের মধ্যেও পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানো এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ পর্ষদের। পাশাপাশি, নতুন শিল্প বা সংস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে পর্ষদের অনুমোদন শেষ কথা। কিন্তু পরিবেশ দফতরের এক কর্তাই বলছেন, ‘‘সবই যদি মেনে চলতে হয়, তা হলে রাজ্যে শিল্পায়ন হবে কী করে!’’

ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নীতি-নির্দেশিকা সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পর্ষদের এই আঞ্চলিক দফতরের। কিন্তু এক পর্ষদ কর্তা বলছেন, ‘‘অনেক সময়েই সেই নীতি মেনে চলা হচ্ছে না বুঝতে পারি। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে আমরা সংস্থা বন্ধ করার নির্দেশ দিতে পারি না।’’ সেই সুপারিশ করলেও তা যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সায় পাবে না, তা-ও জানেন তাঁরা। তাই জেনে-বুঝেও অনেক সময়ে ‘চোখ বুজে’ থাকতে হয় বলে দাবি করেছেন পরিবেশ দফতরের এক কর্তা।

পর্ষদের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তিনটি জেলার কাজকর্ম দেখার জন্য গড়ে চার জন করে ইঞ্জিনিয়ার থাকা দরকার। আছেন মোট তিন জন। জুনিয়র বিজ্ঞানী থাকার কথা অন্তত চার জন। রয়েছেন, দু’জন। প্রতি দিন অগুণতি নমুনা আসে গবেষণাগারে। কিন্তু তা পরীক্ষা করে দেখার মতো পরিকাঠামো নেই। ফলে, কাজ পিছোতে থাকে। রাজ্যে কলকাতার বাইরে এত ভাল গবেষণাগার আর কোথাও নেই। ফলে, নিয়মিত নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সংস্থা সিএমইআরআই, সিএমপিডিআই হোক বা রাজ্য সরকারের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর, জল পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠিয়ে থাকে এখানে। এর বাইরে নিয়মিত বায়ু দূষণ‌ের মাত্রা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের কাজ তো আছে। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘যদি স্থানীয় স্তরে অফিস বা গবেষণাগার গড়ে দেওয়া হয় তাহলে অন্তত চাপ কমে।’’

কিন্তু তাঁদের সেই আর্জি শুনছে আর কে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement