এক পক্ষ আশা দেখছে শহরের ভোটের দিকে তাকিয়ে। আর এক পক্ষের আস্থা গ্রামীণ এলাকার ভোট ব্যাঙ্ক। মেমারি বিধানসভা আসন নিয়ে এমন অঙ্কেই বাজিমাতের স্বপ্ন দেখছে শাসক বিরোধী দু’পক্ষ।
বরাবরের বামেদের শক্ত ঘাঁটি মেমারির রাজনৈতিক ছবিটা বদলে যায় ২০১০ সালের পুরভোটে। ১৬টি আসনের সবকটিই পায় তৃণমূল। সিপিএমের প্রবাদপ্রতীম নেতা বিনয় কোঙারের গড়ে বামেরা সে বার মুখ থুবড়ে পড়ে। ওই পুরভোটে তৃণমূল প্রায় ষাট শতাংশ ভোট পায়। সেখানে সিপিএমের ভোট ছিল চল্লিশ শতাংশ। দু’দলের ভোটের ব্যবধান দাঁড়ায় ৪৮৪১ ভোটের। পরের বছর ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটেও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি সিপিএম। ভোট গণনা শুরু হতে প্রথমে গ্রামীণ এলাকায় এগিয়ে থাকলেও পরে শহরাঞ্চলের ভোটে সিপিএমকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায় তৃণমূল। ঊননব্বই হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে বিধায়ক হন আবু হাসেম মণ্ডল।
তবে সিপিএম প্রার্থী দেবাশিস ঘোষও পঁচাশি হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। সিপিএম নেতাদের দাবি, মেমারি গ্রামীণ এলাকায় দল তিন হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু পুর এলাকায় গণনা শুরু হওয়ার পরে ছবি বদলে যায়। শেষ পর্যন্ত তিন হাজার একশো আটাত্তার ভোটে জিতে যায় তৃণমূল। পরিসংখ্যান বলে, ২০১০ সালের পুরভোটের চেয়ে প্রায় তিন শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে পুর-এলাকায় তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট হয়েছিল পনেরো হাজার আটশো চোদ্দ। সেখানে ছয় শতাংশ ভোট খুইয়ে সিপিএম পেয়েছিল আট হাজার তিনশো একাত্তর ভোট। অর্থাৎ ব্যবধান দাঁড়ায় ৭,৪৮৩ ভোটের।
তবে এই পরিসংখ্যানে মোটেও ঘাবড়াচ্ছেন না সিপিএম নেতারা। বরং এ বারে জয়ের পিছনে অন্য অঙ্ক কষছেন তাঁরা। মেমারির সিপিএম নেতাদের যুক্তি, গ্রামীণ এলাকায় এমনিতেই দলের ভাল সংগঠন রয়েছে। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখে মানুষ এ বার আরও সিপিএমের দিকে ফিরে আসবেন। আবার শহরে তৃণমূল যে বেশি ভোট পেয়েছিল সেখানে কংগ্রেসের বেশ খানিকটা অংশ ছিল। এ বার জোট হওয়ায় সেই অংশের ভোট তাঁদের দিকে চলে আসবে বলেও নেতাদের দাবি। সবমিলিয়ে বিধানসভা নিয়ে যথেষ্ট আশায় রয়েছেন তাঁরা। সিপিএমের জোনাল কমিটির এক নেতা জানান, মেমারি পুর এলাকায় কংগ্রেসের ভাল ভোট রয়েছে। পুরসভা গঠনের সময়ে, ১৯৯৫ সালেও মেমারিতে কংগ্রেসের পাঁচটি আসন ছিল। ২০১৫ সালের পুর-নির্বাচনেও কংগ্রেস শহর থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোট পেয়েছে। ফলে বলায় বাহুল্য, ২০১১-র বিধানসভায় তৃণমূলের জয়ের পিছনে কংগ্রেসের ভোট ছিল। এই নেতার আরও দাবি, ‘‘২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে পুর এলাকায় তৃণমূলের ভোট কমেছে। আবার পুরসভা ভোটে তার চেয়েও ভোট কম পেয়েছে তৃণমূল। অথচ কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে। আর এ বার তো কংগ্রেস আমাদের দিকে।’’ পরিসংখ্যানও বলছে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মেমারি বিধানসভা থেকে তৃণমূল পাঁচ হাজার আট ভোটে জেতে। তার বেশিটাই পুর এলাকার। অর্থাৎ গ্রামীণ এলাকায় থাবা বসাতে পারেনি, উল্টে পুর এলাকাতেও ভোট কমে গিয়েছে তৃণমূলের। গত বছর পুরভোটে তৃণমূল ১৫টির মধ্যে ১০টি আসন পায়। কিন্তু প্রাপ্ত ভোট কমে যাওয়ায় সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের ব্যবধান দাঁড়ায় ৩৬৮১ ভোটের।
যদিও হিসেবের সূক্ষ তত্ত্ব নয়, ফলাফলের উপরেই জোর দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। পুরসভা ছাড়াও মেমারি ১ ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও মেমারি ২ ব্লকের ২টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এই বিধানসভা এলাকার মধ্যে। ওই ১২টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮টি ও পঞ্চায়েত সমিতি দু’টিই তৃণমূলের দখলে। তারপরেও অবশ্য গ্রামীণ ভোট আরও বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। এ বারের তৃণমূল প্রার্থী, নার্গিস বেগমের দাবি, ‘‘পুরসভার ভোট তো আমাদের দিকে আসছেই, কিন্তু গ্রামীণ ভোট বাড়ানো প্রয়োজন। সে জন্য গ্রামের ভোটকেই পাখির চোখ করছি।” মেমারির উপ-পুরপ্রধান সুপ্রিয় সামন্ত বলেন, “পুরসভার ভোট আবার আমাদের দিকে ফিরে আসবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তার সঙ্গে গ্রামের ভোট বাড়ানোর জন্য আমরা ছুটছি।”
পাল্টা সিপিএমের মেমারি জোনাল কমিটির সদস্য সনৎ সিংহের দাবি, ‘‘কংগ্রেসের ভোট আমাদের দিকে এলে পুর এলাকাতেও আমরা জিতছি। তৃণমূল লোকসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে কী ভাবে জিতেছিল সবাই জানে।” এ ছাড়াও গত বারের জয়ী প্রার্থীকে সরিয়ে অন্য জনকে প্রার্থী করাতেও অনেকে বিমুখ হয়ে বিরোধী তরফে ভোট দেবেন বলেও সিপিএমের দাবি।
এমনিতেই প্রার্থী ঘোষণার দিন থেকেই নার্গিস বেগমের নামের সঙ্গে ‘বহিরাগত’ তকমা জুড়ে গিয়েছে। তার উপর রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তা যে সিপিএমের স্বস্তির কারণ হতে পারে বুঝে তৃণমূল প্রার্থীর সাফাই, “কেউ কেউ হয়তো ভুল জানেন। আমি আসলে বর্ধমানেরই বাসিন্দা।” আর এ বারের প্রার্থী তথা সিপিএমের মেমারি জোনাল কমিটির সদস্য দেবাশিষ ঘোষের কথায়, “আমরা এ সব নিয়ে প্রচার করছি না। কিন্তু বিধানসভায় মানুষ স্থানীয়দের উপরেই বিশ্বাস করেন।”