ছবি পিটিআই।
বিধানসভা ভোটে আসনের নিরিখে তারা শূন্য ছিল। পুরভোটের কোনও সমীক্ষাই তাদের হাতে কিছু রাখেনি। কিন্তু কলকাতার পুরভোটে বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোট বাড়িয়ে খানিকটা রাজনৈতিক পরিসর ফিরে পেল বামেরা। বিজেপিকে পিছনে ফেলে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে কলকাতায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা সামনে আরও লড়াইয়ের রসদ জোগাবে বলেই মনে করছেন রাজ্যের বাম নেতৃত্ব। একই ভাবে বিধানসভার তুলনায় ভোট বাড়িয়ে উজ্জীবিত কংগ্রেসও।
প্রায় ৮ মাস আগে জোট বেঁধে বিধানসভায় লড়েছিল বাম ও কংগ্রেস। কোনও পক্ষের বাক্সেই বলার মতো কিছু ছিল না তখন। পুরভোটে দু’টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে বামফ্রন্ট। তার মধ্যে সিপিএমের নন্দিতা রায় ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে এবং সিপিআইয়ের মধুছন্দা দেব ৯২ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী। অন্য দিকে, দু’টি ওয়ার্ড গিয়েছে কংগ্রেসের দখলে। সন্তোষ পাঠক ফের জিতেছেন ৪৫ নম্বরে আর ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন ওয়াসিম আনসারি। ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে দেখলে বামেরা পেয়েছে ১১.৮৯%, যার মধ্যে শুধু সিপিএম ৯.৬৫%। আর কংগ্রেসের ঘরে এসেছে ৪.১২%। বিধানসভার তুলনায় প্রায় ৭% ভোট বেড়েছে বামেদের। যেখানে বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ২০%।
পুরভোটের ফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা বলছে, বিধানসভায় বিজেপির যা ভোট ছিল, তার অনেকটাই এ বার তৃণমূলে গিয়েছে। আবার কিছু ভোট গিয়েছে বামেদের দিকেও। এই ফেরার তথ্যকে সামনে রেখে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব বলার সুযোগ পাচ্ছেন, ‘বাম থেকে রামে’ যাওয়ার তত্ত্ব এতে মান্যতা পায়। এবং এখান থেকেই প্রশ্ন উঠে আসছে, বিজেপির নিজস্ব বলতে তেমন কিছু ভোটব্যাঙ্ক কি এখনও বাংলায় তৈরি হয়েছে? তৃণমূল-বিরোধী যে ভোট বিজেপির বাক্সে গিয়েছিল, তাদের পালে হাওয়া কমতেই তা আবার ফিরতে শুরু করেছে বামেদের দিকে। আর অন্য একটা অংশ মিশে গিয়েছে তৃণমূলে। সব মিলিয়ে পিছিয়ে পড়েছে বিজেপি।
ওয়ার্ডভিত্তিক পরিসংখ্যান নিয়ে দেখলে, কলকাতায় এ বার বামেরা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ৬৫টি ওয়ার্ডে, বিজেপি ৪৮টিতে। আর কংগ্রেস দ্বিতীয় হয়েছে ১৬টিতে। আরও কাটাছেঁড়া করে দেখলে, বামেরা ১২৮টি ওয়ার্ডে লড়ে দু’টিতে প্রথম, ৬৫টিতে দ্বিতীয়। বিজেপি ১৪২টি ওয়ার্ডে লড়ে তিনটিতে প্রথম, দ্বিতীয় ৪৮টিতে।
এ বারের পুরভোটকে ‘প্রহসন’ বলেই আখ্যা দিয়েছে বিরোধীরা। গোটা কলকাতা জুড়েই ভোটে জালিয়াতি ও গা-জোয়ারি চলেছে বলে অভিযোগ বাম ও কংগ্রেসের। এমন ভোটের ফলকে তাই বিরাট গুরুত্ব দিতে নারাজ বাম নেতৃত্ব। তবু তার মধ্যেও পুরভোটের এই ফল তাঁদের উৎসাহ বাড়াচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউনের সময়ে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনী নামিয়ে, নানা কর্মসূচি নিয়ে জন-দরবারে ছিল বামেরা। আন্দোলনে ও কর্মসূচিতে সামনের সারিতে এগিয়ে এসেছিল তরুণ প্রজন্ম। বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকাতেও আধিক্য ছিল তরুণ মুখের, যে ধারাবাহিকতা বামেরা ধরে রেখেছে পুরভোটেও। বাম নেতৃত্বের একাংশের মতে, বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে ঠেকিয়ে সরকার গড়ার তাগিদে ভোট হয়েছে বলে হয়তো তরুণ, নতুন মুখ আনার প্রভাব নির্বাচনের ফলে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পুরসভার ভোটে স্থানীয় স্তরে কাজ করার কিছুটা ‘সুফল’ পাওয়া গেল। এবং সেই জায়গায় পিছিয়ে থাকল গেরুয়া শিবির।
একই ভাবে বিধানসভায় শূন্য হয়ে গেলেও পুরসভার ভোটে প্রার্থী হওয়ার জন্য রীতিমতো বিক্ষোভ হয়েছিল কংগ্রেস শিবিরে। পুরনোদের পাশাপাশি নতুন, আনকোরা বেশ কিছু প্রার্থীকে ময়দানে নামিয়েছিল কংগ্রেসও। সাধ্যমতো লড়াই তাঁরা করেছেন, সংখ্যালঘু এলাকায় দলের সমর্থন অল্প হলেও বেড়েছে বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি। মাটি কামড়ে লড়াই করে জয় যে সম্ভব, ভোটের দিনে বিস্তর অভিযোগ সত্ত্বেও ৪৫ নম্বরে দলের প্রার্থী সন্তোষের ফের জিতে আসাই তার আদর্শ উদাহরণ— এমনই বলছেন কংগ্রেস নেতারা।
বাম নেতাদের দাবি, ‘ভোট লুঠের’ মধ্যেও বামেদের ফল দেখিয়ে দিচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ভোট আরও বাড়তো। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘শেষ পর্যন্ত দু’জন জিতলেও সেটাই আসল জয়। চুরি-জোচ্চুরি করে যে প্রথম হয়, ‘জানে সে দীনতা আপনার’। বামফ্রন্টের ভোট বেড়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বরোতেই তারা দ্বিতীয় স্থানে।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘ভোট লুঠপাট হয়েছে। তাতেত জনসমর্থন মাপা যায় না। মানুষের মন পাওয়া জেতা-হারার চেয়ে অনেক মূল্যবান।’’
বিস্তর অভিযোগের মধ্যেও পুরভোটের ফলকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ মনে করছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মেয়র হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা নামিনি। সাধ্যমতো লড়াই করেছিলান। কংগ্রেস দু’টি ওয়ার্ডে জিতেছে, ১৬টিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। বিধানসভার তুলনায় ভাল ফল হয়েছে। সংখ্যালঘু এলাকায় আমরা ভাল ভোট পেয়েছি।’’ প্রদেশ সভাপতির মতে, বিজেপির পায়ের তলার জমি সরতে শুরু করেছে। তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা কমছে, কংগ্রেসের বাড়ছে।
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য কটাক্ষ করছেন, ‘‘অঙ্কের হিসেবে কেউ দ্বিতীয়, কেউ তৃতীয় তো হবেই। তবে দ্বিতীয় স্থানও এতই দূরবর্তী যে, মানুষের রায়ের বিচারে তা কিছুই নয়!’’
উল্লেখযোগ্য তথ্য, আনুষ্ঠানিক জোট না থাকলেও কংগ্রেস এ বার যে দুই ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে, সেখানে বামেদের প্রার্থী ছিল না। ঠিক যেমন জোট না থাকলেও গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুরে অধীর এবং মালদহ দক্ষিণে আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী দেয়নি এবং তাঁরা দু’জনেই জিতেছিলেন। কলকাতায় বামেরা অবশ্য যে দু’টি ওয়ার্ডে জিতেছে, সেখানে কংগ্রেসেরও প্রার্থী ছিল। কলকাতার অভিজ্ঞতার পরে অদূর ভবিষ্যতে ফের বামেদের হাত ধরা উচিত কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কংগ্রেসের অন্দরে।