BJP

Bengal BJP: প্রতিপক্ষ তৃণমূল নয়, ঘরোয়া যুদ্ধেই মগ্ন বিজেপি! ছায়ার সঙ্গে লড়াইয়েই ১০ মাস

দিলীপ ঘোষের পরে সুকান্ত মজুমদার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি হতেই সুখের দিন যেন ক্রমে কমতে শুরু করে। একের পর এক বিতর্কে সামনে এসে গিয়েছে দলের অন্দরের যুদ্ধ। যা জিইয়ে রেখেছেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রাক্তন রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার থেকে সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়রা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ১১:৩১
Share:

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

২০২১ সালের ২ মে। এ দিনের আগে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি যেন আলাদা দল। নবান্ন দখলের স্বপ্নে বিধানসভার নির্বাচনের আগে দীর্ঘ সময় গেরুয়া শিবির ঠিক যতটা চাঙ্গা ছিল, এখন ঠিক ততটাই ঠান্ডা। যেটুকু উত্তাপ, তা ঘরোয়া যুদ্ধের। একের পর এক ঘটনায় সেই গৃহযুদ্ধ সামনে এসে যাচ্ছে। যা দেখে বিজেপি নেতারাই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, ‘‘প্রথম বার বিরোধী দলের গুরুত্ব পাওয়ার পরে আমাদের লড়াই হওয়ার কথা ছিল শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবে এখন বিজেপি-র লড়াই বিজেপি-র বিরুদ্ধেই। বিধানসভায় শক্তি বাড়াতে পারলেও ‘নানা মুনি নানা মত’-এ কাহিল নেতৃত্ব। এ যেন ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে।’’ ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পার। হিসাব বলছে, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধের বয়স দশ মাস পার হল।

Advertisement

ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধটা শুরু হয় বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেই। পদ্মের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত ধরে নেওয়া নেতা থেকে কর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করতে শুরু করে। দলে দলে যাঁরা গেরুয়া শিবিরে এসেছিলেন, বিধানসভা ভোটের পরে তাঁদের বড় অংশ বিজেপি থেকে দূরে। কেউ তৃণমূলে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন, কেউ এখনও অপেক্ষায় রয়েছেন। এমন নেতা-কর্মীদের দলে নেওয়া এবং মুখ হিসাবে তুলে ধরে ভোটে লড়া ঠিক হয়েছিল কি না তা নিয়ে প্রথমে বিবাদ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলেছেন কেউ। কেউ আবার দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বকে দুষেছেন।

বিজেপি নেতারাই স্বীকার করছেন, বিধানসভা ভোটের পর থেকেই দলকে আর আন্দোলনমুখী করা যায়নি। ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস নিয়ে যখন আদালতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন রাজ্য নেতারা, তখন নিঃশব্দ ভাঙনে ক্ষয়ে গিয়েছে কর্মীদের মনোবল। রাজনৈতিক সংঘর্ষে আক্রান্ত ও ঘরছাড়া কর্মীদের পাশেও সে ভাবে দাঁড়াতে পারেনি দল। অনেক নেতাই ভোটের পরে এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন। দিল্লি থেকে বাংলায় লড়তে আসা নেতারা কেউ কেউ ফিরে গিয়েছেন। এর পরে মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন বিজেপি-কে যতটা না ধাক্কা দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া বাবুল সুপ্রিয়ের দলত্যাগ এবং পরে তৃণমূলে যোগদান। আসলে এই সময়টায় দু’দুবারের সাংসদ বাবুলের সঙ্গে সরাসরি মন্তব্য-যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ।

Advertisement

দিলীপের পরে সুকান্ত মজুমদার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি হতেই সুখের দিন যেন ক্রমে কমতে শুরু করে। একের পর এক বিতর্কে সামনে এসে গিয়েছে দলের অন্দরের যুদ্ধ। যা জিইয়ে রেখেছেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রাক্তন রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার থেকে সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়রা। বাড়িতে বসে লড়াইয়ে টুইট মন্তব্যে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। আর প্রায় রোজ ভোরেই প্রাতর্ভ্রমণে বার হয়ে খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়ে মন্তব্য করে দলের অন্দরের লড়াই বেআব্রু করে দিচ্ছেন দিলীপ। রাজ্য বিজেপি-র অনেকেই বলছেন, যে ক্ষেত্রে দল চুপ থাকার নীতি নিয়েছে অনেক সময়ে সেটা নিয়েই নিজের মতো করে কথা বলে ফেলছেন দিলীপ। এর ফলে দলে পারস্পরিক বোঝাপড়া আঘাত পাচ্ছে।

দলের এই বেহাল দশা নিয়ে বিরক্ত জেলাস্তরের নেতারাও। সম্প্রতি দলের বৈঠকে যোগ দিতে আসা এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘একের পর এক ঘটনায় মুখ পুড়ছে আমাদের। জেলায় তৃণমূলের সঙ্গে লড়ছি আমরা আর রাজ্যের নেতারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে লড়াই চালাচ্ছেন।’’ কেন বলছেন এমন কথা? ওই নেতা একের পর এক উদাহরণ দিয়ে দেখালে‌ন সম্প্রতি তৈরি হওয়া বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরা। সেই তালিকায় যেমন ছিল কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা হারানো নিয়ে রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারের মুখ খোলার বিষয়, তেমনই ছিল খড়্গপুরে হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের বৈঠক বয়কট করা থেকে বার বার দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের কথা। ওই নেতা বলেন, ‘‘গোলমাল সব দলেই থাকে। কিছু দিন আগেই তো তৃণমূলে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষেরা বিবাদে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু ক’দিন কাটতে না কাটতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটাটা মিটেয়ে দেন। আসলে আমাদের দলে বাঘে, গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। এমন কোনও নেতা নেই, যাঁর কথায় সবাই বিবাদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করবে‌ন।’’

দলের শীর্ষনেতারা যে অনেক বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না সেটা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিজেপি-র ডাকা বাংলা বন্‌ধের দিনে প্রকট হয়ে যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ মিটে যেতেই বন্‌ধ ডাকেন সুকান্ত। পরের দিন সেই বন্‌‌ধ সফল করতে যখন বিভিন্ন জায়গায় দলীয়কর্মীরা পথে তখন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অন্য কথা বলেন। দুপুরেই বন্‌ধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে তিনি দাবি করেন, আচমকা বন্‌ধ ডাকায় সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করে সুকান্তের সঙ্গে। তিনি তখন সব শুনে বলেন, এ ব্যাপারে শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর কোনও কথাই হয়নি। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি শুভেন্দুর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আচমকা বন্‌ধ ডাকা ছাড়া উপায় ছিল না। আমরা হঠাৎ করেই ডেকেছি। কারণ, যে কারণে বন্‌ধ সেই ভোটে সন্ত্রাস নিয়ে তো আর সাত দিন পরে বন্‌ধ ডাকা যায় না।’’

সমস্যার সমাধান সে দিন হয়ে যায়নি। ওই বিতর্কের জের এখনও চলছে। গত শনিবার দলের ডাকা বিশেষ সাংগঠনিক বৈঠকে হাজির ছিলেন না শুভেন্দু। সেখানেও ওঠে বন্‌ধ প্রসঙ্গ। তাতে আচমকা না ডেকে ধীরে সুস্থে এবং সময় দিয়ে বন্‌ধ ডাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন দিলীপ। এখানেই থামেননি। তাঁর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সুকান্তের বন্‌ধ ডাকা নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি নাম না করে অনুপস্থিত শুভেন্দুকেও খোঁচা দেন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার দাবি সেখানে দিলীপ বলেন, ‘‘আচমকা বন্‌ধ ডাকলে অসুবিধা হয়। কিন্তু দল যখন এক বার তা ডেকেছে তখন সেই কর্মসূচিকে সকলের মান্যতা দেওয়া উচিত।’’

তবে বিজেপি-তে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লড়াইটা শুরু হয় সম্প্রতি নতুন রাজ্য কমিটি ঘোষণার পরে। যা আরও বেড়ে যায় বিভিন্ন জেলার নতুন সভাপতিদের নাম ঘোষণায়। একের পর এক বিধায়ক দলের সাংগঠনিক হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ ছাড়তে শুরু করেন। তাতে যোগ দেন দলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। একটা সময়ে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীতে থাকা সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতেশ তিওয়ারি, জয়প্রকাশ মজুমদারদেরও নেতা হয়ে ওঠেন শান্তনু। কলকাতায় সরকারি গেস্ট হাউসে বৈঠক, বনগাঁয় বনভোজন একের পরে এক কর্মসূচিতে দলের ভিতরের লড়াই সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে যেতে হয় সুকান্তকে। সেই সময়ে রাজ্যের বাইরে ছিলেন লকেট। উত্তরাখণ্ডে ভোট মিটলে বাংলায় ফিরেই সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করা শুরু করেন তিনি। ক্ষুব্ধ নেতাদের নিয়ে বৈঠক থেকে দলের সাংগঠনিক বৈঠকে সরব হয়ে রাজ্য কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও লকেট এখন হয়ে উঠেছেন বিদ্রোহীদের মুখ।

দলের মুখ বাঁচাতে সুকান্ত বার বার বলেছেন, ‘‘আমাদের মতান্তর থাকলেও মনানন্তর নেই।’’ কিন্তু তাঁর এই আপ্তবাক্যে এখন ভরসা রাখতে পারছেন না রাজ্য থেকে জেলার নেতারা। অনেকেই মনে করছেন নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে থাকায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়া যাচ্ছে না। দলের যেটুকু লড়াই তার সবটাই আদালতে আটকে রয়েছ। বিক্ষুব্ধদের মূল ক্ষোভ রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে। আদতে আরএসএস নেতা অমিতাভের বিরুদ্ধে বেনজির ভাবে পোস্টারও পড়েছে কলকাতায়। ট্রেনের গায়ে নানা কুৎসায় ভরা পোস্টার দেখা গিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত একটি বারের জন্যও প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি অমিতাভ। তবে রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য মনে করেন, এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও আসলে শাসকের সন্ত্রাসের কারণেই আন্দোলন বিমুখ বিজেপি। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বিজেপি এখন বিচ্ছিন্ন, রাজ্যছাড়া, ঘরছাড়া, জীবন-জীবিকা লুঠ হয়ে যাওয়া কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি আন্দোলনমুখী বিজেপি-র প্রকাশ্যমনতা দেখা যাবে।’’ একই সঙ্গে শমীক মেনেছেন, ‘‘নানা কারণে দল এখন কিছুটা অগোছালো অবস্থা রয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে।’’

এত কিছুর পরেও ততটা অস্বস্তি ছিল না, যতটা তৈরি হয়েছে গত শনিবারের পর। নিজেদের শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসাবে দাবি করা বিজেপি-র উচ্চ স্তরের রুদ্ধধার বৈঠকের সব খবরই বাইরে চলে আসে। যে অন্তর্কলহের খবর কর্মীদের আরও বেশি হতাশ করে তোলার আশঙ্কায় ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের কর্তারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement